অমাবস্যার লাশ - তৈমুর খান

 



তখন ঘরের আলো নিভে গেছে। একটা মুণ্ডুবিহীন লোক যেন আমার ঘরের খোলা দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে। যেই ঘুমোবার চেষ্টা করছি অমনি সে যেন আমার মাথার কাছে ঘোরাফেরা করছে। বাড়িতে আজ একা আছি। কেন এমন হচ্ছে?
  
গত অমাবস্যার রাতে বসির উদ্দিনের মাথাকাটা লাশ নিজ হাতেই পুনরায় কবরস্থ করতে হয়েছে। চোখের সামনে সে দৃশ্য ভোলার নয়। তারপর থেকে প্রতিটি রাতই আমার কাছে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। ঘুমের ভেতর যে স্বপ্ন দেখছি, সেখানেও ওই লাশ আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছে না। তার মুখ নেই বলে, নাকি ওর ভাষা নেই বলে? আমিই কি তবে অপরাধী? কী ভাবে কী ঘটে গেল নিজেও জানি না, সবই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
    
বসির উদ্দিন ছিল আমার গ্রামের জামাই। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স। হঠাৎ একদিন প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হল। ডাক্তার ডাকার সময় না দিয়েই পৌষ মাসের এক ভরপুর আমাবস্যা নিশিতে প্রাণ ত্যাগ করল। গ্রামের এক তরুণ জামাইয়ের মৃত্যুতে সবাই আমরা শোকে কাতর হয়ে পড়লাম। মসজিদের মৌলবি সাহেব বললেন,

 —আমাবস্যার মৃত্যু, কবরস্থ করলেও সাতদিন কবর পাহারা দিতে হবে। কালী সাধকরা যে কোনো দিন এসে লাশের মুণ্ডুচ্ছেদ করে নিয়ে যেতে পারে।

মৌলবির কথা শুনে আমাদের ভয় ধরে গেল।

গ্রামের লোক সকলে মিলে একটা পরামর্শ করতে শুরু করলাম, কী করা যায়? অবশেষে সিদ্ধান্ত হল, আমরা সাতজন সাতজন করে প্রতিরাতে পালা করে কবর পাহারা দেবো। সবাই জেগে রাত কাটাবো।
 
এভাবেই তিন দিন গত হল। চতুর্থ রাতে আমার পালা। আরও ছয়জন গ্রামের লোকের সঙ্গে আমি খড়ের ছাউনির একটা অস্থায়ী কুঁড়ে ঘরে কম্বল নিয়ে সন্ধে থেকেই উপস্থিত হয়েছি। সঙ্গে আছে একটা কেরোসিন স্টোভ, চা-চিনি। দুটো লণ্ঠন, দুটো টর্চ লাইট। আমাদের মধ্যে যে-সব কথাবার্তা চলতে লাগল তা নিম্নরূপ—
—কালী সাধকেরা মাথা কেটে কী করে?
—কালী সাধনা করে মাথাকে দিয়ে কথা বলায়।
—এ তো ভারি আশ্চর্য! মরার মাথায় কথা বলে?
—বলে তো। দেখিসনি, সেবার স্কুল মাঠের মেলায় জাদুকর এস. কে. বাক্কার একটা জ্যান্ত লোককে কবর খুঁড়ে মাটির নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে কবরের উপর একটা মরার মাথা রেখে কেমন দেখাচ্ছিল। যে যা প্রশ্ন করছিল, নিমেষের মধ্যেই তার উত্তর দিয়ে দিচ্ছিল! অতীতকালে কে একজন বুড়ি গাবতলায় তেঁতুল গাছে গলায়ে দড়ি দিয়েছিল, তার নাম পর্যন্ত।
—হ্যাঁ আমিও দেখেছিলাম। তবে জ্যান্ত লোককে বেশিক্ষণ কবরে রাখা যায় না। শুনেছি বেশিক্ষণ থাকলে তারও মৃত্যু ঘটে।
—ঠিকই শুনেছিস। মরার মাথাকে জাগানোর পদ্ধতি আছে। সে-সব সাধকরা জানে। আমরা যেটুকু শুনেছি তাতে প্রতি অমাবস্যায় নাকি ধূপধুনা দিয়ে মায়ের সামনে আসন পেতে বসতে হয়। তারাপীঠের সাধক বামাখ্যাপা নাকি পাঁচটি মাথা নিয়ে পঞ্চমুণ্ডির আসন করতেন!
—সে হতে পারে, এই যে এত বড় পৌষের রাত আমরা সবাই পাহারা দিচ্ছি। এর ভেতরও যে সাধকরা ওত পেতে নেই কে বলতে পারে!
—হ্যাঁ সুযোগ পেলেই তারা কেল্লাফতে করে ছাড়বে।

আমাদের কুঁড়ে ঘরটির বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তৃতীয়ার একফালি চাঁদ কখন ডুবে গেছে। গাছপালায় ভর্তি কবরস্থান যেন এক ভয়ংকর অরণ্য। একটা শেয়ালের মতো প্রাণী বাইরে দৌড়ে গেল। ছোট ছোট খেঁজুর গাছগুলিকে মনে হল, কবরস্থ ছেলেমেয়েরা মেঝের ওপর উঠে বসে আছে। তাদের মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আবার কখনো মনে হল, আল্লাহর ফেরেস্তারা কবর স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাপীদের শাস্তি দিচ্ছেন। এসব ভাবছি একমনে আর ইতিমধ্যেই কেউ কেউ নাক ডাকতে শুরু করেছে। আর একবার চা পান করার ইচ্ছে থাকলেও হয়ে উঠল না। লণ্ঠনের পলতেটা একটু উসকে দিয়ে চোখ বুজে মনে মনে 'আয়াতুলকুরশি' পাঠ করছি, ঠিক তখনই উপলব্ধি করলাম এক ছায়ামূর্তি সাবধানে আমাদের কুঁড়ের দরোজায় এসে ঠাণ্ডা মতো কী বায়বীয় জাতীয় পদার্থ স্প্রে করে দিল। আমি নাক চেপে ধরলাম, কিন্তু উঠতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর ছুটে বাইরে এলাম। দেখলাম কেউ কোথাও নেই। হঠাৎ ভয় পেয়ে আবার ঢুকে গেলাম। যারা ঘুমোচ্ছিল, তাদের ধাক্কা মেরে ওঠাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উঠতে পারল না কেউই। ওঠার চেষ্টা করেও আবার বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।
    
বহু কষ্টে একাই সাহস সঞ্চয় করলাম। 'আল্লাহ আকবর' বলে খুব জোরে একটা হাঁক মারলাম। কবরের দিকে একটু এগিয়ে গিয়েও আবার পিছিয়ে এলাম। সঙ্গে টর্চ তো নিতে হবে। মনে পড়তেই আমার টর্চখানা নিয়ে দু'পা ফেলেই কবরের দিকে টর্চ মারলাম। গাছেরাও বড়ো বড়ো পা ফেলে যেন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সবাই ঘাসের আড়ালে টর্চের আলোয় ছায়া হতে লাগল। আলো-আঁধারিতে আরও রহস্যময় দেখাল কবরস্থান। এ সবের মধ্যে দিয়েই যে দৃশ্য দেখলাম তা নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয় না। সম্পূর্ণ উলঙ্গ বিরাট বপুর একজন মানুষ, এক হাতে ধরে আছে একটি নরমুণ্ড, অন্যহাতে একটি চকচকে ছুরি। দ্রুত বেগে পিঠটান দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে হারিয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম ব্যপারটি। সাধক সুযোগ বুঝে আমাদের অচৈতন্য করে লাশের মাথা কেটে প্রস্থান করল। কিন্তু এমন উলঙ্গ হয়ে মাথা কাটতে হয় পূর্বে কখনও শুনিনি।
    
আমি পিছিয়ে আসতে পারলাম না, এগিয়ে যেতেও পারলাম না। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছি। ব্যাপারটি সকলে জানলে আরও বিপদ। কী করা যায় ভাবতে লাগলাম। অবশেষে এক বুদ্ধি মাথায় এল। লাশটা পুনরায় কবরস্থ করে দিলে কেউই জানতে পারবে না। আমাদের পাহারা দেওয়ার সুনামও বজায় থাকবে। টর্চের আলো ফেলে সাবধানে এগিয়ে গেলাম। দোয়াদরুদ যা কিছু জানা ছিল, সমস্তই একে একে পাঠ করে বুকের ডান দিকে বাঁ দিকে ফুঁ দিলাম। লাশের কাছে গিয়ে দেখি, লাশ প্রায় পচন ধরার মুখে। কাফন থেকে সম্পূর্ণ লাশকে কবরের উপরে তোলা হয়েছে। তারপর মাথাটি কেটে নিয়ে ফেলে পালিয়েছে। 'বিসমিল্লাহ' বলে মাথাকাটা লাশটিকে কাফনে জড়িয়ে কবরের ফুটো করা আংশে নিচের দিকে ঠেলে ভরে দিলাম। যেমন পূর্বের মাটি চাপা ছিল, ঠিক তেমনি করেই মাটি চাপা দিয়ে ঠিকঠাক করে দিলাম। একবার শুনেছিলাম এক প্রেমিক নাকি তার প্রেমিকাকে কখনো সঙ্গম করতে পারেনি। এতই সে আশিক হয়ে পড়েছিল যে মৃত অবস্থাতেও মেয়েটিকে পেতে চেয়েছিল। পারিবারিক ও সামাজিক সম্মান রক্ষার্তে প্রেম করার দায়ে মেয়েটিকে হত্যা করেছিল তার পরিবারেরই লোকজন। তারপর কবরও দিয়েছিল। কিন্তু রাত্রির অন্ধকারে প্রেমিক এই কবর থেকেই তার প্রেমিকাকে তুলে সঙ্গম করছিল। ধরা পড়ে তারও নাকি মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। আমিও সকলের অজান্তে যে কাজ করে চলেছি তা কখনো ফাঁস হবে না তো?
    
কবরস্থ করে ফিরে আসি খড়ের কুঁড়ে ঘরটিতে। তখন 'আল্লাহ আকবর' বলে ভোরের আযান পড়তে শুরু করেছে। আরও ছয়জন লোক তখনো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। এবার আর কোনো কিন্তু নয়, তাদের ধাক্কা মেরে ঘুম ভাঙাই। চেঁচিয়ে বলি,
—ফজরের আযান হল। ওজু করে নামাজ পড়বে না?
সবাই উঠে বসে বলে,
—চলো কবরটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে আসি।
 
সবাই দেখে এসে আশ্বস্ত হয়। যেমন ছিল তেমনই আছে। আমি হাত মুখ ধুয়ে ওজু করে নামাজে সামিল হই। নিজের কৃত কর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।
   
কিন্তু হায় সেই থেকে আমার আর মুক্তি নেই। একা থাকলেই প্রতিটি রাতে সেই লাশের হেঁটে আসা বুঝতে পারি। সে এসে আমার কাছে দাঁড়ায়, কিছুই বলতে পারে না। বিছানা ছেড়ে উঠে আলো জ্বালি, কিন্তু কিছুই দেখা যায় না। আবার আলো নিভিয়ে দিই। এভাবেই সারারাত চলতে থাকে। এক রকমের মানসিক ভয়, না আতঙ্ক? না লাশের স্মৃতি আমার মনকে এভাবে তাড়িত ও বিধ্বস্ত করছে? তবে কি শেষ পর্যন্ত ঘটনাটার কথা সবার কাছে স্বীকার করতে হবে?
    
মৌলবি সাহেবের কাছে গিয়ে সে-সব কথা আর বলতে পারি না। কারণ, লাশটাকে আমি সঠিক ভাবে পাহারা দিতে পারিনি। আবার মাথাকাটা অবস্থায় কবরের ফাঁক দিয়ে জবুথবু ভাবে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছি এ সব কি অপরাধ নয়?

ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে আসি। দেখি একটা ছায়ামূর্তি আমার আগে আগে হেঁটে চলেছে। তার মাথাটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। কতগুলি কুকুর ভ্যাক্ ভ্যাক্ করে পরক্ষণেই ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে শুরু করল। দেখলাম ছায়া মূর্তিটি কবর স্থানের দিকে যেতে শুরু করেছে। আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলতে লাগলাম,
—কে, কে তুমি? এত রাতে আমার কাছে কেন এসেছ?

ছায়া মূর্তি কোনো উত্তর দিল না। ঈষৎ সে লম্বা হয়ে দ্রুত মিলিয়ে গেল। আমি কোন্ দিকে যাব আর ভেবে স্থির করতে পারলাম না।



জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট সংলগ্ন পানিসাইল গ্রামে । বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো। পেশা শিক্ষকতা। নব্বই দশকেই লেখালেখি শুরু। ১৯৮৪ সালে প্রথম রামপুরহাট কলেজ ম্যাগাজিনে স্বনামে কবিতা প্রকাশ। তারপর ১৩৯৪ বঙ্গাব্দে ‘বিকল্প’ পত্রিকায় ‘স্বপ্ন ভাঙা রাতের আলো’ নামে ছোটগল্প। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “কোথায় পা রাখি" (১৯৯৪) দৌড় প্রকাশনা থেকে। প্রথম ছোট গল্পের বই ‘জীবনের অংশ’ (২০১৬) প্রকাশিত হয় আবিষ্কার প্রকাশনী থেকে। দ্বিতীয় গল্পের বই 'ইজ্জত'(২০২৫) প্রকাশিত হয় চেতনা প্রকাশনী থেকে। এ পর্যন্ত ২৪ টি কাব্যগ্রন্থ, ১টি উপন্যাস ও ১০টি গদ্যের বই প্রকাশিত হয়েছে। পুরস্কার পেয়েছেন :কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার, দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুনগতি সাহিত্য পুরস্কার, কবি আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার, বার্ণিক সাহিত্য সম্মান এবং সুখচাঁদ সরকার স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি । ঠিকানা :রামরামপুর (শান্তিপাড়া), ডাকঘর :রামপুরহাট, জেলা বীরভূম, পিন কোড ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ । ফোন নম্বর ৯৩৩২৯৯১২৫০