সে ~ মৌসুমী ঘোষ দাস


                     

ট্রেনটা ধীরে ধীরে স্টেশন এসে থামতেই মুখোমুখি আসনের যাত্রীটি আড়মোড়া ভেঙে তপনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, -“কোন স্টেশন এলো দাদা?”

-“সামসি”।

-“মালদা আর কতক্ষণ?”

-“এখান থেকে মালদা আর ঘণ্টা দুয়েক লাগবে”।

দু মিনিট পর ট্রেনটা আস্তে আস্তে গতি নিলে দরজার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সেই যাত্রীটি আবার বলল,

-“ওই, সে ট্রেনে উঠল। এ বাবা! সে তো এদিকেই আসছে। বড্ড অস্বস্তিকর”।

-“চুপচাপ চোখ বুজে ঘুমের ভাণ করে থাকুন না মশায়, ডিস্টার্ব করবে না”।

-“বলেন কি? ঘুম থেকে টেনে তুলবে দাদা। অভিজ্ঞতা আছে। আপনি ঘুমের ভাণ করে দেখুন না একবার”।

-“না, আমার কাছে আসবে না। আমায় চেনে কিনা”।

-“আপনি চেনেন?”

-“হ্যাঁ, ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় থাকতো যে!”

-“তাই নাকি? ছোট থেকেই- ?”

-“না না, ছোট থেকে ওর মধ্যে একটু মেয়েলী ভাব ছিল বটে। তবে ওরা খুব গরিব ছিল কিনা, তাই একটু বড় হতেই – এই ধরুন চোদ্দ/পনের বয়স হবে, তখন ওর বাবা রোজগারের আশায় ওকে পাড়ার মনসা গানের দলে দিয়ে দেয়। সেখানে খুব নামও করেছিল সে। দলের পরিচালক ওকে তো নায়িকা বেহুলার পার্ট দিয়েছিল। অসম্ভব সুন্দর অভিনয় করত সে”।

-“তা সেটা কি এখন আর করেনা?”

-“পয়সার লোভ বুঝলেন কিনা। দিব্যি চলছিল, কোথা থেকে খবর পেয়েছিল একসঙ্গে প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে বিহার গেলে- ”।

-“বলেন কি বিহারে?”

-“হ্যাঁ, বিহারে কোনো এক পরবের পর নাকি গ্রামে মঞ্চ বেঁধে ভাড়া করা মেয়েদের দিয়ে উদ্দাম নাচ গান হয়। অনুষ্ঠানের নাম ‘রঙ্গরস’ না কি জানি একটা। সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলে প্রচুর টাকা দেয়। খবর পেয়ে সেখানে গিয়েই তো কেলেঙ্কারিটা হয়।”

-“কেলেঙ্কারি?”

-‘হ্যাঁ, সুন্দরী মেয়ে সেজে নাচ দেখাতে গিয়ে গ্রামের মাতব্বরদের লোলুপ দৃষ্টিতে পড়ে গেল!’

-“বলেন কি? তারপর?”

-“একদিন রাতে ঘুমিয়ে থাকাকালীন তাবু থেকে তাকে মুখ বেঁধে তুলে নিয়ে গেল মাতব্বরদের লোকেরা। সেখানে তাকে নিয়ে যখন জানলো সে আসলে ছেলে, মেয়ে নয়। তখনও রেহাই দিল না জানেন! রাতভর অকথ্য শারীরিক অত্যাচারের পর ভোরে তাবুতে ফেলে দিয়ে গেল। লজ্জায় না কি অপমানে কে জানে একমাস ঘর বন্দী হয়ে কাটিয়েছিল সে। তারপর থেকেই এমন পাল্টে গেল”।

-“ছিঃ! কোথায় আছি আমরা, ছেলেদের সঙ্গে যদি এমন হয়, তবে মেয়েদের অবস্থাটা ভাবুন দেখি!”

–“এখন অবশ্য সুখী নিরাপদ জীবন কাটাচ্ছে সে। টাকাপয়সাও অতি সহজেই রোজগার হচ্ছে। তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে আর কেউ তাকায়ও না। রাত বিরেতে বেরুলেও কেউ তাকে আর উৎপীড়ন করার সাহস পায় না। বরং এড়িয়েই চলে”।

-“কি নাম ওর?”

-“অরুণ। এখন অরুণা হয়ে গেছে। অরুণা হিজড়ে”।

মৌসুমী ঘোষ দাস