ক্ষণিকের আলো ~ মৌসুমী ঘোষ দাস

  

[১]


সায়নি রাতের সব কাজ তাড়াতাড়ি সেরে বিছানায় মুঠোফোনটা কাছে নিয়ে এসে বসল। এখন শুধুই সোহাগের ফোনের অপেক্ষা। রোজ রাতে দুজনার কথা বলার প্রবল আন্তরিক আকর্ষণটা যেন নিত্যদিনের অলিখিত রুটিনে পরিণত হয়েছে, যেন কথা না বললে খাবার হজম হবে না। রোজ রাতের মতো আজও কথা বলবে ওর সাথে। সোহাগ, ওর একমাত্র প্রানাধিক প্রিয়তম। অফিস যাতায়াতের পথে প্রায়ই ওর সাথে চোখাচোখি হত, কিন্তু সায়নির প্রবল ইচ্ছে হলেও কথা হয়নি কোনোদিন। তারপর ফেসবুকে বন্ধুত্ব থেকে আলাপ দুজনার। এখন তা গভীর ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। যদিও সোহাগ বিবাহিত। স্ত্রী এক পুত্র আছে। কিন্তু একসাথে থাকে না। ডিভোর্সের আবেদন করেছে দুপক্ষই। খুব সম্ভবত সামনের মাসেই ওদের ডিভোর্সটা পাকাপাকিভাবে হয়ে যাবে।

ওদের একমাত্র ছেলে শুভম, তার মায়ের কাছেই থাকবে বলে ঠিক হয়েছে। সোহাগ তার নিজের বৃদ্ধা মাকে নিয়ে এখন একটা ছোট ফ্ল্যাটে থাকে। সোহাগ ছোট থেকেই মাতৃভক্ত বলে সকলের কাছেই বিশেষ পরিচিত। আত্মীয়-পরিজন থেকে চেনা-পরিচিত সকলেই জানে, মায়ের জন্য সোহাগ সব করতে পারে। মাও খুব গর্বিত এই জন্য। আসলে স্বামী মারা যাবার পর ছোট্ট সোহাগকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন কিনা! আজকাল তো ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে বাবা-মাকে ভূলেই যায়। সোহাগের মাতৃভক্তির জন্য সোহাগের মাকে অনেকেই হিংসে করে। এই বৃদ্ধা মাকে নিয়েই তো স্ত্রীর সাথে অশান্তিটা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়িয়েছে। সোহাগ শেষ পর্যন্ত স্ত্রী সন্তানকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত হলেও বৃদ্ধা গর্ভধারিণীকে ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। সায়নিকে দু দুবার মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। মা শান্ত-শিষ্ট লাজুক সায়নিকে ছেলের জন্য পছন্দ করেছেন, মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদও করেছেন। স্ত্রীর সাথে ডিভোর্সটা হয়ে গেলেই পাকাপাকিভাবে সায়নিকে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে সোহাগকে অনুমতি দিয়েছেন। সেই মত সোহাগ ও সায়নি উকিলের সাথে আইনি পরামর্শ করে প্রস্তুতি নিচ্ছে।


[২]


সারাদিন টুকটাক কথা হলেও রাতে এই সময়টায় ওরা একান্তে একে অপরকে উজাড় করে দেয়। সারাদিনের ভাল মন্দ অভিজ্ঞতা, আনন্দ, আদর বিশেষ করে ওদের দুজনার বিবাহ পরবর্তী জীবন নিয়ে নানা পরিকল্পনা চলে। সায়নি এখন একটি লেডিস হস্টেলে থাকে। হস্টেলে ওর পারসোনাল একটি ঘর আছে, তাই কারো সাথে বেড শেয়ার করতে হয় না। এর জন্য অবশ্য ওকে মাসে মাসে বেশি টাকা গুনতে হয়। তাতে কি? সায়নি আর টাকার হিসাব করে না এখন। অনেক তো হল হিসাব করে চলা। মা বাবাকে দেখা, তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী নিজে বিয়ে না করে ছোট দুটো বোনকে উপযুক্ত করে বিয়ে দেওয়া। সবাই সুখি আছে আজ। কিন্তু সায়নি কেমন আছে, সে খোঁজ কেউ নেয় না এক সোহাগ সেন ছাড়া।

ওর কি ইচ্ছে, কখনও কেউ জানতে চায়নি ।মা বাবার তিনটিই কন্যা, পুত্র নেই। আজও স্পষ্ট মনে পরে সায়নির, জ্ঞান হবার পর থেকেই মা বাবা শুধু বলতেন, ‘তুমি সন্তানদের মধ্যে বড়। তাই তোমার দায়িত্ব কর্তব্য অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। আমাদের তো আর ছেলে নেই। আশাকরি তুমিই সেই শুন্যস্থান পুরন করবে’। ছোট বেলা থেকেই সায়নির মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, সে প্রথম সন্তান। তাই তার দায়িত্ব কর্তব্য আর সবার থেকে আলাদা। ছোটো থেকেই সায়নি আত্মীয় স্বজনদের মুখে মা বাবার তিন মেয়ে হয়েছে বলে সহানুভুতি পূর্ণ ‘আহা উহু’ মন্তব্য শুনেই আসছে। যেন ওরা তিন বোন নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে এসে মস্ত অপরাধ করে ফেলেছে, ওরা ছেলে হয়ে জন্মাল না ওদের নিজের দোষে।

এই সব মন্তব্য ছোট থেকে শুনতে শুনতে নিজের নারী জন্মের প্রতি এক ধিক্কার জন্মেছে। মা বাবার ছেলে না থাকার দুঃখ ঘোচাতে তাই ছেলের মত সব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, নিজের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। বিয়ের বয়স অনেক দিন হল পার করে এসেছে। ৩৭ বছর চলছে এখন। মা বাবা কোনোদিন ওর বিয়ের জন্য চেষ্টাও করেননি। লজ্জার মাথা খেয়ে সে নিজেও নিজের বিয়ের জন্য ভাবেনি। আর রূপবতী ছিল না বলে কোনদিন যোগ্য প্রেমিকও জোটেনি। নিষ্ঠার সাথে পড়াশুনা করে ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে। ভাল মাইনে। এতদিন মা বাবাকে দেখেছে। এখন ওঁনারা গত হয়েছেন। বাবার তৈরি করে যাওয়া সামান্য ছোট মাথা গোঁজার ঠাইটা ভাড়া দিয়ে এখন ও একটা লেডিজ হস্টেলে থাকে।

সায়নি ছেলের মত সব দায়িত্ব পালন করলে কি হবে, স্বভাবত সে খুব ভীতু ও দুর্বল মনের মেয়ে। বাবার তৈরি করে যাওয়া বাড়িতে একা থাকতে ও খুব ভয় পায় এখন। কারণ, খুব বাজে এলাকায় ওদের বাড়িটা। ওই এলাকায় বেশির ভাগ বাড়িতেই বাংলা মদ তৈরি হয়। বড় বড় গ্যালনে করে তৈরি মদ বিক্রির জন্য এলাকার বাইরে যায়। তাই সর্বক্ষণ পাড়াতে বাজে লোকের আনাগোনা। বাবা সামান্য কেরানির চাকরি করে তিন মেয়েকে খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছেন আর এই রকম একটা পরিবেশে এই সামান্য মাথা গোঁজার ঠাইটা করতে পেরেছেন। তাঁদের গত হতেই দুই বোন জামাইয়ের নজর পড়েছে এখন বাড়িটার ওপর। যুক্তি হল, সায়নি একা অবিবাহিত মেয়েমানুষ, ব্যাংকে ভাল চাকরি, সন্তান সংসার নেই। ওর আর বাড়ির কি প্রয়োজন? কাজেই বাড়ি বিক্রি করো আর ভাগ নাও। এটা কেউ ভাবেনা যে, ৬০ বছর পর্যন্ত চাকরি করে তারপর সায়নি কোথায় যাবে? কে দেখবে ওকে?

মা-বাবার মৃত্যুর পর তো বেশ কিছুদিন ভাল মাইনের চাকুরিরতা সায়নিও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। ভাল চাকরি করলে কি হবে? এই সমাজ একা একটি মেয়েকে তো নিরাপদে বাঁচতে দেয় না- একথা সায়নি বোঝে। সমাজের হিংস্র পশুগুলির হাত থেকে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবে ভিতু সায়নি? তখন মাথার ওপর একটা শক্ত-পোক্ত ছাতা খুঁজত অবিরত। নিজের বোন, বোন–জামাইরা কেউ তখন পাশে এসে দাঁড়ায় নি। শুধু বাড়ি বিক্রির চক্রান্ত করেছে। আজ সোহাগ একরাশ ভালবাসা নিয়ে তার জীবনে আসায় যেন মাথার ওপর শক্ত-পোক্ত একটি ছাতা খুঁজে পেয়েছে সায়নি। কিছুদিনের মধ্যেই সোহাগের সাথে বিয়েটা হয়ে যাবে। আর ওকে একা ঘর নিয়ে হস্টেলে থাকতে হবে না! নিজের নতুন একটা সংসার হবে ভেবে মাঝে মাঝে ভারি রোমাঞ্চ হয় সায়নির।

যদিও সোহাগই সায়নিকে প্রথম প্রস্তাব দেয়। সায়নিও রাজী হয় এই ভেবে যে, একে তো সোহাগ ভদ্র ছেলে বলে মনেমনে প্রথম থেকেই একটা গোপন ভাললাগা ছিলই, তাছাড়া সারাজীবন একাকীত্বের যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর চেয়ে একটা নিজের সংসার হবে, আপনজন হবে!


[৩]



আজ শহরের একটি প্রেক্ষাগৃহে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিল সায়নি হস্টেলের নীরা, তিথির সঙ্গে। ওদের বয়স অনেক কম। এম এ পড়ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওরাও সায়নির সাথে একই হস্টেলে থাকে। সায়নিকে বড্ড ভালবাসে, দিদি বলে ডাকে। ওরা তিন জন একসাথে এসেছে অনুষ্ঠান দেখতে। মাঝের সারিতে কোনার দিকে বসেছে ওরা। সোহাগেরও আসার কথা বন্ধুদের সাথে। যদিও ওদের একসাথেই আসার কথা ছিল। কিন্তু নীরা আর তিথির সামনে সোহাগের সাথে পাশাপাশি বসতে লজ্জা পায় সায়নি। তাই আলাদা আসার ব্যবস্থা। একটু পরেই সোহাগ এল বন্ধুদের সাথে। সোহাগকে কি যে সুন্দর লাগছে আজ! সায়নি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সোহাগকে।

সোহাগ একটু মজা পেতেই বন্ধুদের নিয়ে ঠিক পাসের সারিতে এমনভাবে বসেছে, যেন ইছে করলেই সায়নিকে দেখতে পায়। কারন সায়নি সামনাসামনি সোহাগকে দেখলে খুব লজ্জা পায়, আর সেটা সোহাগ খুব উপভোগ করে। যথারীতি সায়নির সাথে চোখাচোখি হল, আর সায়নির বুক ঢিপ ঢিপ শুরু হল। হাত পা কাঁপতে লাগল। সায়নি কিছুতেই বুঝতে পারে না এই বুড়ো বয়সেও কেন এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয় সোহাগকে দেখলে? কিছুতেই যেন স্বাভাবিক হতে পারেনা। একরাশ লজ্জা, না কি নার্ভাসনেস এসে গ্রাস করে ওকে! অথচ ফোনে কত সাবলীল ভাবে কথা বলতে পারে! সামনে এলে কেন এমন হয় কে জানে? অনেক চেষ্টা করেও সায়নি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা। প্রেমে বোধহয় মানুষ এমনটিই হয়! জীবনে কখনও প্রেমে পরার সুযোগ তো পায়নি সায়নি। তাই সে কোনোদিন জানত না প্রেমের কেমন অনুভূতি। ঈশ্বর বুঝি এখন সেই অনুভূতি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আর তো মাত্র কটা দিন পরেই সোহাগের সাথে বিয়েটা হয়ে যাবে! তখন সোহাগের সামনে কিভাবে যে দাঁড়াবে- ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় শ্যামবর্ণা সায়নি। সোহাগ তার জীবনের প্রথম প্রেম, তাকে গভীর ভাবে ভালবাসে, তবুও সবার সামনে নিজের এই অদ্ভুত আচরণে অপ্রস্তুত লাগে যেন!

অনুষ্ঠানের মাঝে বিরতিতে পর্দা পড়ল মঞ্চ খানিকটা গুছিয়ে নিতে। সোহাগ হলের বাইরে থেকে ফোন করে জানাল যে মা একা বাড়িতে রয়েছেন তাই সে পুরো অনুষ্ঠান না দেখে ফিরে যাচ্ছে। তবে ওর বন্ধুরা পুরো অনুষ্ঠান দেখে যাবে।

সোহাগ বেড়িয়ে যেতেই সায়নির আর মন বসে না। বিয়ে যতই এগিয়ে আসছে সায়নির মনের জগতে যেন সোহাগ ছাড়া আর কিছু নেই! আগে এই ধরনের অনুষ্ঠান পেলে মন দিয়ে সবটা দেখে তারপর ফিরত, আর আজ? নিজের এই পরিবর্তনে নিজেই লজ্জা পায় সায়নি। কিন্তু কিছুতেই যেন মনের আবেগকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারে না। আসলে সারাদিন সময় হয় না বলে রাতে দুজন একটু কথা বলে। নিরিবিলি রাতে ওদের প্রেম যেন গাঢ়তম হয়ে ওঠে। পুরো অনুষ্ঠান দেখলে অনেক রাত হয়ে যাবে, তখন আর কথা বেশি বলা যাবেনা। তাই সায়নি কিছুক্ষণ ছটফট করে নীরা আর তিথিকে বলল,

- ‘আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। তোমরা না হয় পুরো অনুষ্ঠান দেখে ফিরো, আমি ফিরে যাই এখন’।

- ‘না দিদিভাই, তুমি একা কেন যাবে? আমরাও যাব। পরে কখনো সুযোগ পেলে একসাথে অনুষ্ঠান দেখব তখন’।

ওরা হস্টেলে ফিরে এল। সায়নির খুব বিবেকে বাঁধছিল, শুধুমাত্র ওর জন্য মেয়ে দুটো এত ভাল অনুষ্ঠান না দেখে চলে এল! কিন্তু সোহাগের সাথে রাতে কথা বলার আকর্ষণ সব চিন্তাকে ম্লান করে দিল।

রাতে সায়নি তাড়াতাড়ি খেয়ে এসে মুঠোফোনটা কাছে নিয়ে বসল। এখন শুধুই সোহাগের ফোনের অপেক্ষা। আজ সোহাগকে দেখতে দারুন লাগছিল, খুউউউব আদর করবে আজ সোহাগকে। কিছুক্ষণ পরেই সোহাগের ফোন এল। সায়নি খুশীতে পাগলের মত প্রানাধিক প্রিয়তমর ফোনটা রিসিভ করল। কিন্তু- কেমন যেন অদ্ভুত চাপা গলায় ফিস ফিস করে ওপ্রান্ত থেকে সোহাগ জানাল, সে নাকি বাথরুম থেকে লুকিয়ে কথা বলছে! আজ রাতে, এমনকি আর কখনো হয়তো সায়নির সাথে কথা বলতে পারবে কি না কে জানে! কারন সন্ধ্যাবেলা এক ঘটনা ঘটেছে। সোহাগের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী-পুত্র হঠাৎ এ বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। তার স্ত্রী মায়ের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চেয়ে নাকি ভুল স্বীকার করে বলেছে, সোহাগের বৃদ্ধা মা কে নিয়ে থাকতে তার আর কোন অসুবিধা নেই। সোহাগের সাথেও মানিয়ে চলবে এবং কিছুতেই সে আর ডিভোর্স চায় না। সোহাগের মাও নাকি একমাত্র নাতির মুখের দিকে চেয়ে বউমাকে এবারের মত মাপ করে দিয়ে, ছেলের সাথে সংসার করার একটা সুযোগ দিতে চেয়েছেন। সোহাগও নাকি অগত্যা রাজি হয়েছে, কারণ সে বরাবর মায়ের বাধ্য ছেলে ছিল। আজই বা অবাধ্য হয় কিভাবে?

মৌসুমী ঘোষ দাস