তা অন্ততঃ একশ সওয়াস শ বছর আগে ছিল। এখন নেই। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে অবস্থাটা ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করেছে। বিলাসিতার নদীতে নয়, একেবারে সাগরে ডুবে ছিলেন জমিদার অনন্ত মুখোপাধ্যায়।
বিলাসিতা ছাড়া আভিজাত্যের প্রকাশ হয় না ঠিকভাবে এমন ছিল মত তাঁর। কিন্তু আয়ের সঙ্গে ব্যয় পা মিলিয়ে চলতে পারে নি। ফলে দেনার সাগরে ডুবতে বসেছিল জমিদারি। এক এক করে মৌজার পর মৌজা বিক্রি হতে হতে হাতে পড়ে থাকা ভাবনার সঙ্গী পেনসিলটার মতই পড়েছিল সংস্কারহীন ভাঙ্গাচোরা বিশাল বাড়িটা।
জমিদারিটা নেই তবে মেজাজটা আছে তার নিজস্ব ভঙ্গিতেই। শারদীয়া পুজোয় মা কাত্যায়নীর আরাধনা এই মেজাজের একটা দিক। বেশ ধুমধাম করে এই পুজো হয় প্রতিবার।
দরিদ্রসেবা, কাঙালভোজন, বস্ত্র-বিতরণ এরকম জনহিতকর কাজের সঙ্গে আর একটা যা আশপাশের অন্ততঃ দশটা গ্রামকে মাতিয়ে রাখত তা হল, নবমীতে পাঁঠাবলি। জমিদারের নিজস্ব একশ আটটা তো বটেই তা ছাড়া থাকত মানতের আরও বহু।
পুজোর প্রধান পুরোহিত, তন্ত্রধারক ছাড়াও অতিরিক্ত দুজন পুরোহিত আছে শুধু এই পাঁঠাগুলোকে স্নান করিয়ে কপালে সিঁদুর লেপে বলির জন্য উৎসর্গ করতে। সোনাকামার আর নাটাকামার এগুলোকে লাইন দিয়ে বেঁধে রাখছে।
পাশাপাশি দু-দুটো হাড়িকাঠ রেডি করা আছে। পাশে রাখা আছে তীক্ষ্ণধার দুটো খাঁড়া। পাশে সার দিয়ে বেঁধে রাখা নিরীহ পশুগুলো মাঝে মাঝে ডাকছে। তাদের এই ডাক হয়ত নিছক কৌতূহলে অথবা খিদে পেয়ে যাবার জন্যে। না হলে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে তাদের মত অবোধ পশুরা আর অবহিতই বা হবে কি করে?
বিরাট ধুমধাম। বিশাল লোকের মেলা। মণ্ডপের বাইরে সত্যিকারের মেলাও বসেছে। সেখানে নানান খেলনা, পুতুল আর গৃহ সজ্জার জিনিসের পাশে বাচ্চা ছেলেমেয়ে আর নানান বয়েসের মেয়েদের ভীড়।
সারা বছর জমিদারবাড়ি খাঁ খাঁ করে। সাবেক জমিদারির প্রতীক বিরাট বিরাট থামওলা বিশাল বিশাল ঘরে ভরা বাড়িটা মাত্র জনাতিনেক বাসিন্দাকে গিলে খাবার তৃপ্তি অনুভব করে। জমিদারের উত্তরসুরী রমেশ মুখুজ্জে রেলের চাকরি থেকে বছর দুয়েক আগে অবসর নিয়েছেন। বৌ মারা গেছে বছর দশেক আগে। মেয়ে ললিতা বিধবা হয়ে পাকাপাকিভাবে বাপের বাড়িতে এসেছে তার বিয়ের পরের বছর থেকেই। আর বিয়ে সে করে নি। শ্বশুরবাড়ি তার স্বামীর সম্পত্তি থেকেও তাকে বঞ্চিত করেছে। রমেশবাবু কেস করেন নি। ভীষণ সাদাসিধে লোক তো।
ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। থাকে কলকাতার বাইরে। বছরে একবার আসে এই পুজোর সময়। বিয়ে হয় নি অথবা করে নি। আর মা নেই তাই সেটা দেবার চাড়ও নেই হয়ত কারো। বেশ একটু আবেগপ্রবণ। মানুষ তো বটেই, জীবজন্তুদেরও কষ্ট দেখতে পারে না। তাই বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে অনেকেরই “খোরাক” হতে হয় তাকে। একটু আধটু কাব্যচর্চা করে। বোধহয় সেই আবেগেরই তাড়নায়। নীলের এবারে বাড়ী আসতে দেরি হয়েছে। প্রাইভেট কোম্পানী। কাজটা কর্মীর হাতে হলেও ছুটিটা মালিকের হাতে। আর সেটা ক্যালেন্ডারের লাল কালির দাগ মানতে চায় না কিছুতেই। তাই অষ্টমী অবধি অফিস খোলা।
বলি শুরু হয়ে গেছে। ঢাকের তালে নাচছে ঢাকি। সেই সঙ্গে কাঁসর ঘণ্টা ঘড়ি শাঁখ কত কি। মণ্ডপে ভীড়, ধূপ আর ধুনোর গন্ধে ম ম। পুরোহিতের গমগমে মন্ত্রোচ্চারণ। মানুষের হাসিগল্প আর ভক্তি গদগদ উচ্ছ্বাস।
ঠিক পাশেই একটা মণ্ডপে বলির আয়োজন। এক একটা পাঁঠাকে হাড়কাঠে আটকে দিচ্ছে একজন। আর সোনা আর নাটাকামারের চকচকে ধারালো খাঁড়া গুলো চকিতে আকাশের বিজলির মত চমকাচ্ছে। ওদের দাঁড়ানোর সময় অবধি নেই। ওরা চোখ খুলে কিংবা চোখ বুজে আছে তাও তারা জানে না। কেননা তাদের সে অনুভূতিই নেই এখন। এখন তারা আর মানুষ নয়। এক একটা কলের পুতুল যেন। যান্ত্রিক গতিতে খাঁড়াগুলো নেমে আসছে পাঁঠাগুলোর ঘাড়ে। একেবারে চুলচেরা পরিমাপে । এতটুকু দিকভ্রম নেই। নেই এতটুকু কৌণিক বিচ্যুতিও।
মুণ্ডুগুলো সব ছিটকে পড়ছে ওপাশে। সেগুলোর একটা অংশ নাকি সোনা আর নাটা কামারের প্রাপ্য। চুক্তি আগেই হয়ে আছে। সোনা আর নাটা জাত-মাতালের মত তাল ঠিক রেখে সেই মুণ্ডুগুলো গুনে চলেছে। সবার শেষে ধড় আর মুণ্ডুর সংখ্যা মিলিয়ে দেখা হবে। পাওনা গণ্ডার সব হিসেব মুখে মুখে আর মনে মনেই আছে। কোনও গণনা যন্ত্রের প্রয়োজন নেই।
দরদরিয়ে রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে গঙ্গার মত। তবে এই গঙ্গার জলের রঙ টকটকে লাল। কজন লোক কোদাল হাতে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে তারা হাতের কোদাল দিয়ে নালা আরও চওড়া করে দিচ্ছে। পবিত্র রক্তের স্রোত বাধাহীন আনন্দে বয়ে চলেছে নিজ লক্ষের দিকে।
হঠাৎ বলির মণ্ডপে একটা হৈ হৈ। বলি প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম। সোনা আর নাটা দুজনেই কোমরে দুহাত দিয়ে সঙের মত দাঁড়িয়ে। চোখ তাদের টকটকে লাল।
কি হল ব্যাপারটা? তবে কি পাওনাকড়ি বা মুণ্ডু ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলা বেধেছে ওদের মধ্যে? কিন্তু সব হুল্লোড় ছাপিয়ে একটা পুরুষ কণ্ঠ ক্রমশঃ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। আর সব কণ্ঠ অস্পষ্ট হচ্ছে।
গলাটা নীলের।
- এসব চলবে না। এভাবে অকারণে নিরীহ পশুদের হত্যা করা কেন? তোমরা বলি বন্ধ কর।
জমিদারি না থাক জমিদার আছে। ইঞ্জিনিয়ার হোক আর যাই হোক গাঁয়ে তো তার পরিচয় জমিদারপুত্র বলেই। সুতরাং সম্ভ্রমের পাল্লায় বেশ একটু ঝুঁকেই থাকবে নীল। সকলে চুপ করে গেল। দু-একজন বয়স্ক কিছু বোঝাতে গেল কিন্তু নীল সে সব কানেই তুলল না।
চেঁচামেচিতে পুজো বন্ধ করে উঠে এলেন রমেশবাবু। উঠে এল আর সব পুরোহিতরা। সব বয়স্ক আর মাতব্বররা।
- বাবা তোমাকে বলেছিলাম না এবার পুজোয় বলি বন্ধ করতে?
মাথা ঠাণ্ডা রাখলেও পুজোর উদ্যোক্তা আর প্রধান পুরোহিত হওয়ার সুবাদে উত্তেজনা তো একটু থাকবেই। আচার-বিচারে ঘাটতি হচ্ছে কিনা সবাই তা লক্ষ করছে। এটা একটা সম্মানের বিষয় বটে। কিন্তু এই অর্বাচীনকে এখন বোঝানোর দায়িত্বটা কে নেবে?
- বন্ধ কর বললেই কি আর বন্ধ করা যায়? রমেশবাবু বললেন, প্রথা রয়েছে আচার রয়েছে।
- এতগুলো পশুর অকারণে প্রাণ নষ্ট করা যায় অথচ প্রথাকে নষ্ট করা যায় না কেন বাবা? প্রথার তো প্রাণও নেই যে সে কষ্ট পাবে? পশুর বদলে এমন কুপ্রথাকে বলি দাও না কাজ দেবে।
বোঝাবার চেষ্টা করলেন বাবা ছেলেকে। ছেলে বুঝল না। বাবার ছেড়ে দেওয়া হাল এবার ধরতে এলেন পাড়ার আর গ্রামের মাতব্বরেরা। আলোচনা হতে লাগল শাস্ত্রের। তর্ক চলল শাস্ত্র আর বিজ্ঞান আর যুক্তি বোধের।
যুক্তি হেরে গেল। কারণ সে সংখ্যার বিচারে গৌণ। নীলের সঙ্গে আরও অনেক নব্যপন্থী এল বটে তবে তারা সংখ্যা-লঘুত্বের তখমা নিয়ে অচিরে বিশ্রাম করতে গেল।
আবার ঢাক বাজল। আবার বলি শুরু হল। সবাই নিশ্চিন্ত হল। একটা নিশ্চিত অমঙ্গলের গ্রাস থেকে রক্ষা পেল গ্রামটা।
হাড়কাঠের দিকে জোর পায়ে এগিয়ে গেল নীল। আবার বিপদ গনল সকলে। মাথা-গরম ছেলেটা না জানি কি না কি করে বসে? সোনা আর নাটাও খুব চিন্তিত। তাদের যদি মারধোর করে বসে মালিকের ছেলে বলে কি বলবে আর কি করবে তাই ভাবতে বসে গেল তারা।
- বাবা, শেষবারের মত বলছি বলি বন্ধ করবে কি না?
- না না না। বাবা দৃঢ় স্বর জানিয়ে দিল অবিচল সিদ্ধান্তটা। আর সকলের নিশ্ছিদ্র নীরবতা অকুণ্ঠ সমর্থন জানাল রমেশবাবুকেই।
স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছে নীল। চোখের তারা স্থিরভাবে নিবদ্ধ হাড়কাঠের পশুটার দিকে। আবার বেজেছে ঢাক ঢোল শাঁখ। সোনা কামারের হাতের ধারালো খাঁড়া আবার উঠেছে তার মাথার ওপর। বিদ্যুতের মত উঠেছে ঝিলিক দিয়ে।
সেটা নামল চকিতে। নিমেষে ঘাড় আর গর্দান আলাদা করে দিয়েছে নিখুঁত দক্ষতায়। মুণ্ডুটা চকিতে গিয়ে পড়েছে ওপারে। তবে মুণ্ডুটা পাঁঠার নয়। একটা মানুষের। নীল ছুটে গিয়ে পড়েছিল সেই খাঁড়ার নীচে। কেউ বুঝতেই পারে নি যে বাধা দেবে।
এই অবধি পড়ে পাঠক নিশ্চয় সাব্যস্ত করবেন যে, এরপর থেকে দুঃখ, অনুতাপ আর অনুশোচনায় বলি বন্ধ হয়ে গেল? না, তা যদি হত তবে আজও সারা পৃথিবীতে কোটী কোটী মানুষ হিংসার খড়গে বলি হচ্ছে কেন? একটা মাত্র বলি সারা বিশ্বে কোটী কোটী নরবলি বন্ধ করে দেবে – হে পাঠক, মনুষ্য সমাজের সুবুদ্ধির এমন প্রশংসা ভুলেও করবেন না।
৯ই অক্টোবর ২০১৩
