১
বিকেল সাড়ে তিনটা বাজে। ঋকের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। তৃষা মাইক্রোওভেনে ওর খাবার গুলো গরম করতে করতে কাজের মেয়ে পূর্ণিমাকে নির্দেশ দিল,
- ‘ডাইনিং টেবিলে খাবার ঢাকা থাকবে, ঋক ফিরলে আগে ওর জামা প্যান্ট ছাড়িয়ে, জুতো মোজা খুলিয়ে, হাত মুখ ধুইয়ে তারপর খেতে দিবি। খেয়ে একটু ঘুমোতে বলবি। আর বলবি, মা এই একটু বাজারের দিকে গেছে, এখুনি চলে আসবে। ওহ! আর ওকে বলিস সন্ধ্যা বেলা মানি আসবে’।
মানি মানে তৃষার দিদি দিশা। ঋকের আদরের মানি। ঋককে ছোট থেকে কোলে কাঁখে মানুষ করেছে। দুটো গলির পরেই ঋকের মানির বাড়ি, মানে ঋকের দাদু বাড়ি। ঋকের মানি বিয়ে করেনি। যাই হোক পূর্ণিমা তৃষার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। পূর্ণিমাকে নির্দেশ দিয়ে তৃষা তাড়াতাড়ি গা ধুয়ে হালকা সুতির একটা ছাপা শাড়ি পরে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। আসলে তৃষা চাইছে ঋকের বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই বাজার থেকে ফিরে আসতে। কারণ, ঋক কখনো মা ছাড়া একা থাকতে পারে না। আর তৃষাও ঋককে একা ছেড়ে থাকতে পারেনা। যেখানে যায় সঙ্গে নিয়ে যায়। আজ বিশেষ প্রয়োজনে ঋককে ছাড়াই বেরোতে হচ্ছে।
আগামীকাল ঋকের জন্মদিন। এবার ঋক গীটারের ডিজাইনের কেক কাটতে চেয়েছে। তাই কেকের অর্ডারটা দিতে হবে আজই। তাছাড়া ঋক বেশ কিছুদিন ধরে একটা ভিডিও গেমের কথা বলছে। স্কুলের ওর প্রিয় বন্ধু সিদ্ধার্থের কাছে দেখেছে। সেটা সারপ্রাইজ গিফট দিতে চায় তৃষা। তাই ঋককে ছাড়া একা বাজারে বেরোনো। বাজারে কেনাকাটা কিছুটা সেরে সবে কেকের দোকানে ঢুকতে যাবে আর অমনি বাড়ি থেকে পূর্ণিমার ফোন। এই হয়েছে এক কাজের মেয়ে, কোন কথা বুঝিয়ে বললেও যেন বোঝে না! বার বার শুধু ভ্যাবলার মত প্রশ্ন করবে কি যেন বললেন বউদি? এমনিতে স্বভাব চরিত্র ভাল মেয়েটার, বিশ্বাসী। কিন্তু অসম্ভব বোকা! তৃষা বেশ বিরক্ত হয়েই ফোনটা ধরল,
-কি ব্যাপার রে পূর্ণিমা? এই তো সবে তোকে বুঝিয়ে বলে বেরুলাম, এর মধ্যেই আবার প্রশ্ন? মাথায় কি কিছুই থাকে না তোর? তাড়াতাড়ি বল কি হয়েছে? এখনো প্রচুর কাজ বাকি।
-বউদি, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসো। ঋক বাবা –
-কি হয়েছে ঋক সোনার? স্কুল থেকে ফেরেনি?
-তুমি এক্ষুনি চলে এসো বউদি।
-আরে কি হয়েছে বলবি তো?
ফোনের ওপ্রান্ত থেকে পূর্ণিমার ভয়ার্ত কণ্ঠের কান্না ছাড়া আর কিছুই বোঝা গেল না। তৃষা তাড়াতাড়ি একটা রিক্সা নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। বাড়ির কাছে এসে দেখে বাড়ির ভেতরে বাইরে পাড়ার লোকের ভিড়। বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো তৃষার! হাত পা কেমন যেন কাঁপছে! কিছু অঘটন ঘটলো না তো ঋকের? স্কুল থেকে ফেরার পথে কোনো এক্সিডেন্ট বা অন্য কিছু!
ভিড় ঠেলে ঘরে ঢুকতেই পূর্ণিমা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-ও বউদি গো, ঋক বাবা ফাঁসি দিয়েছে!
তৃষা হতভম্ব হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ পূর্ণিমার দিকে চেয়ে রইলো! কি বলছে পাগলের মত মেয়েটা? মাথা খারাপ নাকি? ঋক ফাঁসি দিতে যাবে কোন দুঃখে! আর কিভাবেই বা দেবে? ক্লাস ফাইভে পড়া ছোট্ট ঋক যে কিনা মাকে ছাড়া এক মুহূর্তও চলতে পারে না! ভাল করে নিজের জামা প্যান্টটাও পরতে পারে না, যে নিজে ভাল করে ভাত মেখে খেতে পারে না, একা শুতে পারে না, সেই ঋক, তাদের একমাত্র আদরের সন্তান সেই ছোট্ট ঋক নাকি মায়ের সালোয়ার কামিজের ওড়না দিয়ে ফাঁসি দিয়েছে! কোথায় শিখল সে ফাঁস দেওয়া! বিশ্বাস করতে পারছে না তৃষা! কি দুঃখ হয়েছিল ছোট্ট ঋকের! ওকে তো কোন বকাবকিও করা হয়নি! মারধোর তো কখনই করা হয়না! তবে কি এমন হল! স্কুলে কি কেউ কিছু বলেছে? ওর মাথায় এই বুদ্ধিটাই বা এল কোথা থেকে! কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তৃষা!
পূর্ণিমাকে জিজ্ঞেস করল,
-কি আবোলতাবোল বকছিস? তাছাড়া তুই কোথায় ছিলি? কি করে এমন হল? তোকে না বলে গেলাম, ঋক ফিরলে কাপড়জামা ছাড়িয়ে খেতে দিবি! ওকে একা ছাড়লি কেন রে মুখপুরি?
-আপনি বেরিয়ে যেতেই ঋক বাবা স্কুল থেকে ফিরেছে। মুখটা ভার ছিল। আপনি যা যা বলতে বলেছেন আমি তাই তাই বলেছি বউদি। ঋকের স্কুলের জামা প্যান্ট খুলতে চেয়েছি। ও তখন বলেছে, আমি একটু পড়ার ঘরে ব্যাগটা রেখে আসি। এই বলে দোতলায় উঠেছে। দশ মিনিট হয়ে গেলেও নামছে না দেখে ওপরে উঠে দেখি ঘরের দরজা ভেজানো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখি ঋক আপনার ওড়নার ফাঁস দিয়ে ঝুলছে।
তৃষা আর শুনতে পারলো না, ছুটে দোতলায় ঋকের ঘরে গেল। দেখে ঋক বিছানায় শুয়ে আছে। যেন ঘুমোচ্ছে! তৃষা ফেরার আগেই পূর্ণিমা লোক ডাকাডাকি করে ওড়না কেটে ঋককে নামিয়েছে যদি বাঁচানো যায় এই ভেবে। কিন্তু ঋক কোন সাড়া দেয় নি। পাড়াতেই এক ডাক্তার ছিলেন। তাকে ডাকা হলে এসে বলেন ওড়নার ফাঁসে নয়, ফাঁস লাগার আগেই ভয়ে বা অন্য কারণে ঋক হার্ট ফেল করে মারা গেছে।
তৃষা তবুও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে ঋক আর নেই। আজ সকালেও তো স্কুল যাবার আগে পূর্ণিমা থাকা সত্ত্বেও নিজে হাতে ঋককে তৈরি করেছে। খাওয়ানোর সময় আগামীকাল ওর জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কত পরিকল্পনা করেছে মায়ের সাথে! অসম্ভব! ঋক নিশ্চয় ঘুমিয়ে আছে।
ওর জন্য যে ভিডিও গেম টা কিনে এনেছে সেটা ঋকের কাছে নিয়ে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকছে,
-দেখ ঋক, তোর বন্ধুর যেমন আছে বলেছিলি, আমি তোর জন্য তার চেয়েও বেশি ভাল আর সুন্দর একটা ভিডিও গেম নিয়ে এসেছি। ওঠ, চোখ খুলে দেখ। আর কত ঘুমোবি সোনা? ওঠ মানিক আমার! কাল তোর জন্মদিন! কেকের অর্ডারটা এখনো দেওয়া হয়নি রে। চল সোনা, তোকে নিয়ে যাবো কেকের অর্ডার দিতে। তুই পছন্দ করে দিবি!
ঘরে ভিড় করে থাকা অন্যান্যরা তৃষাকে ঋকের কাছ থেকে টেনে সরিয়ে অন্য ঘরে নিয়ে গেল। তৃষা তবুও বলে যাচ্ছে,
- আমি বলে গিয়েছিলাম ঘুমোতে তাই ঋক ঘুমোচ্ছে, একটু পরেই ও ঘুম থেকে উঠে যাবে দেখো তোমরা!
ঋকের মানি দিশা খবরটা শুনেই পাগলের মতো ছুটে এসেছিল। এসে দেখে, যে ঋককে সে কোলে পিঠে আগলে মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করেছে, সেই ঋক যেন কালঘুম ঘুমিয়ে আছে। আর ওর মা তৃষা কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। পাড়ার সবাই ওর মাকে সামলাচ্ছে। দিশা সে সব না দেখে আগে ওর পড়ার ঘরে ঢুকে বইপত্র ব্যাগ আনাচ কানাচ খুঁজতে লাগলো। কি এমন কারণ থাকতে পারে যে ক্লাস ফাইভের একটি বাচ্চা ছেলে এভাবে মরার কথা ভাবতে পারে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখে ব্যাগের ভেতর ভাঁজ করা ঋকের হাফইয়ারলি পরীক্ষার মার্কশিট। অবাক কাণ্ড! আজ যে স্কুলে মার্কশিট দেবে সে কথা তো বাড়িতে জানায়নি ঋক! মার্কশিট খুলে দেখে তাতে অংক আর বিজ্ঞানে কম নম্বর পেয়েছে সে। যথাক্রমে ৩৩ আর ২৮। অথচ বাকি সব বিষয়েই ৮০% এর ওপর নম্বর পেয়েছে। তবে কি ঋক এই জন্য এমন কাজ করলো? বরাবরের ভাল ছেলে এমন কম নম্বর পেয়ে হতাশ হয়ে, না কি ভেবেছে মা, মানি বকবে! তাই কি ভয় পেয়ে এমন কাণ্ড করে বসলো? দিশার মাথা যেন ঠিক মত কাজ করছে না! ভাবতে পারছে না কিভাবে ওইটুকু ছেলে ফাঁস লাগাতে পারলো! কোথায়ই বা শিখল ফাঁস লাগানো?
২
ওই ঘটনার পর তিন মাস কেটে গেছে। ঋকের বড়মামা স্নেহাংশু অস্ট্রেলিয়া থেকে কদিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। সেই দিন সন্ধ্যাবেলা স্নেহাংশু, দিশা ওদের মা এক সাথে বসে চা খেতে খেতে কথা বলছিলেন। তৃষার মা দুঃখ করে বলছিলেন,- তৃষার দিকে তাকানো যায় না! কি চেহারা হয়েছে মেয়েটার! ঋকের ওভাবে চলে যাওয়ার পর তো তৃষাটা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে। কেবল ঋকের পড়ার ঘরে ঢুকে ওর ব্যবহৃত জিনিসপত্র ছুঁয়ে দেখতো আর বিড়বিড় করে নিজের মনে অদৃশ্য কার সাথে যে কথা বলতো! অমিত শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ঋকের ঘরটা তালা বন্ধ করে দেয়। অনেক চিকিৎসা করিয়ে তবে এখন একটু সুস্থ আছে। তাও নাকি মাঝে মাঝে রাতে ঋকের স্বপ্ন দেখে।
-স্বপ্ন দেখবে না? জানিস দাদা, সারাদিন ঋকের কথাই বলতো! আমি কত বুঝিয়েছি, দেখ বোন ঋক আর নেই, কোনোদিন ফিরে আসবে না! তবু মানতে চাইতো না! কেবল বলতো ঋক আছে, আমার সাথে সে কথা বলে।
- ওতো ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় খুব ভাল ছিল মা। আবার পড়াশুনাটা শুরু করুক না? তাতে সময়ও কাটবে। কোন কাজও করতে পারবে ভবিষ্যতে। বলল স্নেহাংশু।
-আর পড়াশুনা! ছোট বেলা থেকে পড়াশুনায় ভাল হয়ে কি লাভ হয়েছে বলতো? অল্প বয়সে অতি পেকে গেছিল যে! তাই না মাধ্যমিকের পরেই ও পাড়ার অমিতের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়েটা করে ফেলল। নইলে পড়াশুনা ঠিকমত করলে আমি নিশ্চিত যে দিশার মত তৃষাও আজ চাকরি করতো। বিয়ের পরেও কতবার বলেছি পড়াটা শুরু করতে। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তো কোল আলো করে ঋক চলে আসে। তখন তো কেবল ছেলেকে নিয়েই পাগল! মন দিয়ে ছেলে মানুষ করা ছাড়া নিজের কথা ভাবার সময় ছিল না কি ওর?
-জানিস দাদা, পালিয়ে বিয়ে করার জন্য শাশুড়ি প্রথম থেকেই ওকে কুনজরে দেখত। তাই ওর পড়াশুনার ব্যাপারে আগ্রহই দেখাতো না। বলতো বিয়ে করার এতো শখ ছিল যখন, এবার মন দিয়ে ছেলে মানুষ করো। পড়াশুনা করে লাভ কি?
-মা জানো, অস্ট্রেলিয়াতে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রেততত্ব নিয়ে গবেষণা করছি। খুব ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট! ভাবছি ঋককে প্ল্যানচেটে ডেকে জিজ্ঞেস করবো কেন এমন করলো?
-ওসব বুজরুকি দাদা! একজন মারা গেলে তার দেহটা পুরে ছাই হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্মের মত তার সব শেষ হয়ে যায়। আত্মা বলে কিছু আছে কি না, আমি তা বিশ্বাস করি না।
-বুজরুকি আর যাই হোক বাবা, তুই একবার চেষ্টা করে দেখ দেখি।
তার পরদিন স্নেহাংশু যথারীতি প্ল্যানচেট করে ঋককে ডাকলেন। প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়ে ঋকের আত্মা এলে, তাকে জিজ্ঞাসা করা হল,
-তুই কেন এমন করলি বাবু? তোকে কি কেউ কষ্ট দিয়েছিল?
– আমি তো মরতে চাই নি মামা। শুধু মাকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম, যাতে মা আমার রেজাল্ট দেখে বকাবকি না করেন। জানো মামা, আমি মার ওড়নাটা গলায় আলতো করেই পেঁচিয়েছিলাম। কিন্তু জানিনা, কি করে যে মরে গেলাম।
- তোর মা-বাবা তোর জন্য কত কষ্ট পাচ্ছেন বল তো? কেমন একা হয়ে গেছেন! তোর মানি, দিম্মা, আমি সবাই কত কষ্ট পাচ্ছি!
-মাকে কষ্ট পেতে বারণ করো, মাকে বোলো আর ১৪ মাস পর আমি মার কাছে আবার ফিরে আসবো।
প্ল্যানচেটে আসা ঋকের কথা দাদার মুখে শুনে তো তৃষা এবং অমিত অবাক! ঋক আবার আসবে? কি করে ১৪ মাস পর ঋক ফিরে আসবে? ডাক্তার যে বলেছেন, আর কোনোদিনই তৃষা মা হতে পারবে না! তৃষার নাকি জরায়ুতে কি একটা প্রবলেম আছে! কখনই কোন অবস্থাতেই তৃষার মা হওয়া সম্ভব নয়।
দিদি দিশা বলল, -ওসব প্ল্যানচেট ফ্ল্যানচেট বুজরুকি বোন। আত্মার এসে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাওয়ার ঘটনা কোন পরীক্ষিত সত্য নয়। তাছাড়া আজকাল গবেষকরাও প্ল্যানচেট নিয়ে ইন্টারেস্টেড নয়। তুই দাদার ওসব কথায় কান দিস না তো । পড়াশুনাটা আবার শুরু কর। দরকার হলে একটা বাচ্চা দত্তক নে। দেখবি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আসলে ঋক জন্মাবার দু বছর পর তৃষা আর একবার গর্ভবতী হয়েছিল, কিন্তু ছয় মাসের সময় পা পিছলে সিঁড়ি থেকে পরে গিয়ে তৃষার বাঁচার কোন আশাই ছিল না। অনেক কষ্টে তৃষাকে বাঁচানো গেলেও পেটের সে সন্তান আর পৃথিবীর মুখ দেখেনি। আর সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কখনো তৃষার মা হবার সম্ভাবনাও চলে যায়।
৩
ওদিকে ঋকের মামা স্নেহাংশু অস্ট্রেলিয়া ফিরে গিয়ে আবার বন্ধুদের সাথে একদিন প্ল্যানচেট করে ঋককে ডাকে। সেখানেও ঋক এসে মামাকে একই প্রশ্নের একই উত্তর দেয়। আর বলে ১৪ মাস পরে মায়ের কাছে ফিরে আসবো। স্নেহাংশু ফোনে তৃষাকে জানায় তার দ্বিতীয় প্ল্যানচেটের কথা।
দিশা সব শুনে বলে, -প্ল্যানচেটের কথা আমি কিছুতেই মানি না। কিছুতেই বিশ্বাস করি না যে, ঋক এসে বলে গেছে সে আবার জন্মাবে। তবে তোরা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারিস, এখন তো অনেক উন্নত নতুন পদ্ধতি আবিস্কার হয়েছে। যদি চেষ্টা করে আবার মা হতে পারিস তাহলে তোর একাকীত্ব কাটবে।
এবার তৃষা আর অমিত ছোটে ডাক্তারের কাছে, ডাক্তার অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন,
- খুবই জটিল ব্যাপার। দেখা যাচ্ছে মা না হওয়ার সম্ভাবনাই ৯৯%। যদি বা অনেক চেষ্টায় গর্ভ ধারণ সম্ভব হয়, তবে মা ও বাচ্চার দুজনার পক্ষেই বেশ ঝুঁকির হবে। আমি তো আপনাদের বলবো বাচ্চা আর না নিতে। তবুও আপনারা যখন এতো করে চাইছেন, আমি চেষ্টা করতে পারি।
এ ঘটনার ঠিক দু মাস পরে অদ্ভুত ভাবে তৃষা গর্ভবতী হয়। ডাক্তার জানালেন খুবই ক্রিটিক্যল ব্যাপার! খুব সাবধানে থাকতে হবে হবু মাকে! নইলে মা এবং সন্তানের যে কারো সমস্যা হতে পারে। কিন্তু সাবধানে থাকবে কি, তৃষার মনে যে আনন্দ আর ধরে না। ঋক আসছে। কথা রেখেছে সে। ওর পছন্দের জিনিসগুলো কিনতে হবে না! এতদিনের ঋকের বন্ধ ঘরটা পরিষ্কার করে সাজাতে হবে! নইলে ও এসে কি বলবে? আমি ছিলাম না বলে আমার ঘরটা আগছালো করে রেখেছ তোমরা? তখন ওকে কি জবাব দেবে তৃষা?
মা দিদি যতই বোঝায়, আজকাল সব কিছুই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। কোন কিছুই আগে থেকে কেনার প্রয়োজন নেই, আগে সুস্থ ভাবে বাচ্চা জন্মাক, তারপর সব কেনা যাবে। কিন্তু তৃষা অবুঝের মত করে। কেবল দিন গোনে! উত্তেজনায় ঘুম চলে যায় তৃষার! কবে আসবে ঋক সোনা! অমিতকে প্রশ্ন করে করে পাগল করে দেয় সে।
৪
অবশেষে এল ঋকের আগমনের দিন। কিন্তু তৃষার এবং বাচ্চার দুজনারই অবস্থা ভয়ানক জটিল! ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, বাচ্চার অবস্থা ভীষণ ক্রিটিক্যাল! উল্টো অবস্থায় আছে। মুভ করতে গিয়ে গলায় নাড়ি পেঁচিয়ে গেছে। বাচ্চার বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম! সাবধানে অপারেশন করে বার করতে হবে। মায়েরও প্রেশার বেড়ে গেছে, সুগার হাই। এদিকে তৃষাকে বাচ্চার জটিল অবস্থার কথা জানানো হয়নি। একে তো প্রেশার হাই, তার ওপর বাচ্চার জটিল অবস্থার কথা জানলে কি যে পাগলামো শুরু করবে? তখন ওকে নিয়েই ছোটাছুটি করতে হবে।
অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তৃষাকে। ওই অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে কুঁকড়ে গিয়েও তৃষা হাসিমুখে মা, দিদি, অমিতকে বলল,
- আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, ঋক আসছে। তোমরাই আগে ওকে দেখতে পাবে। আমি তো জ্ঞান ফিরলে তবে দেখবো!’
সবাই ওকে মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করে অপারেশন রুমে পাঠালো। উদ্বেগের প্রায় আধ ঘণ্টা পরে নার্স বাচ্চাকে পরিষ্কার করে তোয়ালে পেঁচিয়ে বাইরে তৃষার বাড়ির লোককে দেখাতে আনলেন,
-এই দেখুন, কেমন ফুটফুটে ছেলে হয়েছে! মায়ের আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে যাবে। তখন আপনারা তার সাথে দেখা করতে পারবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, মায়ের সাথে এখন কথা বলা যাবে না।
ভীষণ আনন্দে সবাই চেয়ে দেখল, যেন ঋক ফিরে এসেছে! দিশা দেখল অবিকল যেন ঋক! আর দেখল অদ্ভুতভাবে গলায় একটা পেঁচানো ফাঁসের মত দাগ! অজান্তেই দিশার গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠলো! এ কি করে সম্ভব! প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে দিশা নার্সকে জিজ্ঞেস করল,
-বাচ্চার গলায় ওটা কিসের দাগ?
-জন্মাবার আগে ওর গলায় নাড়ি পেঁচিয়ে গিয়েছিল কিনা, সম্ভবত সেটারই দাগ। আপনারা ডাক্তারকে ধন্যবাদ দেবেন, উনি অনেক কষ্টে বেবিকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন!
দিশা এ যুগের মেয়ে। লেখাপড়া জানা শিক্ষিত যুক্তিবাদী মেয়ে। কোন কুসংস্কার সে মানে না। আত্মা পরজন্ম এসব তো নয়ই। কিন্তু কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না! ওর মত বিজ্ঞানমনস্ক মেয়ের যুক্তি-বুদ্ধি সব যেন কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। ওর বোনের আবার ছেলে হয়েছে, এ পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়। অবিকল ঋকের মতই দেখতে! তাও না হয় মানা গেল। তারপর একেবারে হিসাব করে দিনক্ষণ মিলিয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়া, ঠিক যেমন প্ল্যানচেটে ঋক বলেছিল তেমন? গলায় ফাঁসের মত অবিকল সেই পেঁচানো দাগ! ঋকের কি তবে পরজন্ম হল! এই বিজ্ঞানের যুগে তা কি করে সম্ভব? যুক্তিবাদী দিশা নিজের মনকে শক্ত করার চেষ্টা করল। ঠিক করল, আর ওসব নিয়ে ভাববে না। এখন তাড়াতাড়ি তৃষার জ্ঞান ফিরলেই ভাল। ছেলের মুখ দেখতে পাবে! কম তো কষ্ট করেনি বোনটা!
অমিত খুব খুশী। বলল,
- কখন যে জ্ঞান ফিরবে আর ছেলের মুখ দেখবে তৃষা! ওতো এখনো জানেই না ছেলে না মেয়ে হয়েছে! জ্ঞান ফিরে যখন দেখবে একেবারে ঋকের মত দেখতে হয়েছে, তখন বুঝি আনন্দে উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাবে! এতদিন তো আমাকে কি হবে না হবে বলে বলে মাথা খারাপ করে ছেড়েছে। নামও ঠিক করে রেখেছে, ঋদ্ধি। ঋকই রাখতে চেয়েছিল, আমি বারণ করেছি। তাই ঋকের সাথে মিলিয়ে নাম ঠিক করেছে, ঋদ্ধি। কি কি কিনতে হবে তার আবার একটা ফর্দ করে আমাকে দিয়ে রেখেছে! জ্ঞান ফিরলে ওর সাথে দেখা করেই বাজার ছুটতে হবে।
সবাই বেশ খুশী মনে বাচ্চাকে দেখছে আর তৃষার কথা আলোচনা করছে। এমন সময় ডাক্তার এসে জানালেন,
- ভেরি সরি! কেস খুব ক্রিটিক্যাল ছিল, আপ্রাণ চেষ্টা করেও মায়ের আর জ্ঞান ফেরানো গেল না! হঠাৎ সেখানে বিনা মেঘে বিষম বজ্রপাত হল!
মৌসুমী ঘোষ দাস