কাঁচা হলুদ ~ পর্ণা ব্যানার্জী সরকার





“এক”


রোদের তেজটা আজ বেশ ভালোই ছিল । তাই অন্য দিনের থেকে আজ বেশিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল স্বস্তিকা । মার্কেটিং-এর কাজটা অনেক কষ্টে জোগাড় করতে হয়েছিল। বাবা মারা যাবার পরেই মাকে ঠিক রাখতে হবে । আসলে বাবার কর্কট রোগটা এতোটাই গভীরে আঘাত করেছিল যে সংসারের জমানো পুঁজিটা প্রায় শেষ বললে কিছু ভুল বলা হবে না । বাবার শেষকৃত্য সম্পূর্ণ করে মাকে নিয়ে তাই তড়িঘড়ি দিল্লী থেকে কলকাতায় চলে আসাটাই ঠিক মনে হলো স্বস্তিকার । মামা বাড়ির তরফের কিছু আত্মীয় আছে ডানলপ দমদম সল্টলেকের দিকে, তাই সব চিন্তা ভাবনা করে দমদমেই ঘর ভারা করা হলো । বাবার স্নেহের হাতটা বেশ ভালোই লাগছিলো মাথাতে । কিন্তু ফোনের আওয়াজ যে ক্লান্তির নেশাটা কাটতেই বুঝতে পারলো পুরোটাই মনের ভুল । 'হ্যাঁ স্যার বলুন... হুম আচ্ছা... না না এই বছরেই...না না কোনো ভুল হবে না"... ফোনের কথা শেষ । মা ও মা একটু জল দেবে? আমি বেরোবো ক্লাশ শেষ করে অফিসের বাকি কাজ শেষ করেই । বাড়ি ফিরব রাত হবে, চিন্তা কোরো না । ... এতগুলো কথা বলে গেল স্বস্তিকা কিন্তু ওদিক থেকে কোনো সাড়া এলোনা । উঠে গেলো মাকে দেখতে । সামনে সদর দর্‌জা হাট করে খোলা । দেখে বুঝেও হয়তো বুঝতে চাইলো না সদ্য পিতৃহারা মন । মা মা বলে ডাক দিতে রাস্তায় বেরিয়ে গেল । দোলা কাকিমার বাড়ি নক করে জিজ্ঞেস করলো মা এসেছে কিনা । টুটুল মাসিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো মাকে দেখেছে কিনা । না কোথাও নেই । বাবা মারা যাবার পরেই মায়ের মানসিক ভারসাম্য কিছুটা হারিয়ে ছিল । সেটা ডাক্তার বলেই দিয়েছিল । কিন্তু তার পরিণাম যে এটা হবে স্বপ্নেও ভাবেনি স্বস্তিকা । ওর যেন গা ঘোলাতে শুরু করলো । সামনে পুরোটাই অন্ধকার লাগছিল । জ্ঞান যখন ফিরলো তখন হসপিটালের আলো আর ডাক্তার নার্সদের কথাগুলো কানে আসছিল । চোখ খুলে দেখলো রিন্টুদা দাঁড়িয়ে । পাড়াতুতো দাদা কোনদিন কথা বলেনি স্বস্তিকা । যতবারই রিন্টু দা কথা বলতে চেয়েছে ততবার ওর অস্বস্তি হতো । কারণটা জানা নেই । এড়িয়ে যেত সামনাসামনি চোখে চোখ পড়ে গেলেও । কিন্তু আজ আত্মীয় কেউ নেই দেখে কিছুটা অবাক লাগলো । তাহলে কি কাকুরা খবর পায়নি ? না টুটুল মাসি বাল্তি মাসি কেউ জানেই না ও যে হাসপাতালে ! রিন্টু দা কে জিজ্ঞেস করতে হবে ভেবে ওর কেমন একটা লাগলো । ধুর ! তার থেকে চুপ করে শুয়ে থাকি । ভাবলো স্বস্তিকা।

“দুই”


আচ্ছা, মা কই ? আমার ফোন ? মা. সেকি মা তো ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে আর আমি হাসপাতালে ! উঠে পড়বার চেষ্টা করতেই একটা শক্ত হাত আমার হাতটা ধরে ফেলে বললো, ডাক্তারের বারণ আছে । ওনারা পারমিশন দিলেই তবে উঠতে পারবে । মোটেই ভালো লাগলো না রিন্টুদার কথাটা । তাও কথার উত্তর দেবো না বলেই কথা বাড়ালাম না । নার্স আসতেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আমাকে কখন ছাড়বেন একটু বলবেন ?' ' স্যরি ম্যাডাম. ডাক্তার বাবু সেটা বলতে পারবে । তবে আপনি এখন রেস্ট নিন । আপনার বিপি ভীষণ লো । একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করুন । আপনার হাজবেন্ড বাইরে আছেন । উনিই কথা বলছেন' । 'হাজবেন্ড !!!! কে ? কোথায় ? আমার হাজবেন্ড কোথায় ?' 'কেন ? ওই যে, যিনি একটু আগে আপনার এখানে দাঁড়িয়ে ছিল !' 'না না সিস্টার উনি পাড়ার । আমার কেউ না ।' 'ওহ ! স্যরি ! আমি হয়তো ভুল শুনেছি । আপনি রেস্ট নিন ।' কিছু একটা ভাবছিলাম, কখন যে চোখ লেগে এসেছে জানিনা । রিন্টু দার ডাকে ঘুমটা ভাঙলো । 'ছেড়ে দিয়েছে ডক্টর তবে কিছুদিন রেস্ট দিয়েছেন । বাড়ি চলো ।' আমি তাড়াতাড়ি উঠে সাইড টেবিলে হাত বাড়াতেই দেখি আমার পার্সটা রিন্টু দা বাড়িয়ে দিল । পেমেন্ট হয়েছে । আমি গাড়িতে আছি বাইরে । তুমি এসো ।' উফফফ কী মুশকিল ! যার সাথে কথাটুকু বলার ইচ্ছে নেই, সে কিনা আমার হসপিটাল খরচ দেবে ! আমি বলতে গেলাম 'আমার মেডি ক্লেইম...' কথা শেষও হয়নি তার আগেই রিন্টু দা বাইরে বেরিয়ে গেল । অগ্যতা আমিও রেডি হয়ে বাইরে এলাম । গাড়ির গেটটা খুলেই বসেছিল । তার আবার সামনের সিট । আমি কথা না বাড়িয়ে উঠে বসে বললাম, 'পুলিশ স্টেশন যাব এফ-আই-আর করতে । মাকে খুঁজে পাচ্ছি না ।' 'করা হয়ে গ্যাছে । তবে তোমাকে একটা সাইন করে আসতে হবে । কাকিমার ছবি ও ডিটেইলস সব দেয়া আছে ।' 'মার ডিটেইলস ? কোথায় পেলে ?' 'ছিল । সাথে ছবিও জমা দিয়েছি' 'what the he'll is going on with my life !!!!! আমি একটু অফিসে যাব । কিছু কাজ আছে ।' 'কাল গেলেও চলবে । আমি অফিসকে ইনফর্ম করে দিয়েছি ।' 'মানে ? আমার অফিসে ?' 'হুম তোমার অফিসে' । 'ঠিক বুঝলাম না, আমার অফিসের নম্বর তুমি পেলে কোথা থেকে ? আর কী বলেই বা ওদের ইনফর্ম করলে ? please stop the car ...don't try to be over protective with me ....I don't know u. গাড়ি থামাও আমি বাড়ি একাই যাব । আমার ফোন ! where is my phone?' 'তোমার ব্যাগেই আছে । বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি । নেমে যেও । কেউ বারণ করেনি ।' 'না না আমি ঠিক বুঝতে পারছি না why u r trying to get close with me? আমি একা দেখে এ্যাডভান্টেজ নেবার কথা মনেও আনবে না । দিল্লীতে বড় হয়েছি । ছেলেদের মেন্টালিটি সম্বন্ধে বেশ ভালোই জানি । তাই বেশ ভালোমানুষী দেখাবার দরকার নেই ।' গাড়ির ব্রেকটা বেশ জোরেই কষা হলেও হালকা হেসে বললো 'বাড়ি এসে গ্যাছে । বিকেলে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে । আমি ৫টায় আসবো' ....‌


“তিন”


সকাল সকাল বাবার গাড়ি করে স্কুলে যাবার জন্য যখন রেডি হচ্ছি ঠিক দরজায় বেল চাপলো কেউ । দিল্লীর ঠান্ডায় একে পারছি না, হাত পা জমে যাচ্ছে । তার ওপর মা বললো গেট খুলতে । বাবা ইশারায় বললো রেডি হতে । বাবাই গেট খুলছে । গরম গরম সেদ্ধ ভাত মা মেখে রেডি করে দিয়ে গেল । কী যে দারুণ ! বাবা যেন কার সাথে কথা বলছে আর হাসছে । ধুর ! এখন আবার দেরি হবে আর শেষ মেষ মা বলবে, স্কুল বাসেই যা । ভালো লাগছে না ! বেল বাজলো মনে হয় । নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে । তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম ।


নাহ্ আমি এখনি তো আর সেই বাবান নই । কলকাতায় আছি, বাবা চলে গেছে আর মারও কাল থেকে কোনো খোঁজ নেই । বেল-এর আওয়াজ, খুলে দেখি রিন্টু দা । পুলিশ স্টেশন যেতে হবে । আমিও কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেলাম । গাড়িতে একটাও কথা বলিনি । কিসের নিস্তব্ধতা বয়ে চলেছিল সেটা জানিনা । পুলিশ স্টেশনে ঢুকতেই বড়বাবু চেয়ারে বসতে বলে বললেন, 'জল খাবেন ?' আমি না বলে জিজ্ঞেস করলাম 'স্যার, মার কিছু খোঁজ পেলেন ?' 'হ্যাঁ, সেই বিষয়ে আপনার সাথে একটু কথা আছে ।' 'হুম বলুন !' 'নিবেদিতাদেবি কি সুস্থ ছিলেন না ?' 'স্যার, মা সুস্থই ছিল, তবে সবে তো বাবা মারা গ্যাছেন মাত্র একমাস হয়েছে । মা সেই শোক থেকে এখনো উঠতে পারেনি । তবে মার মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছেইল । যেমন একা চুপ করে থাকতো । খেতে চাইতো না । কিন্তু নরমালি ঘরের কাজ, রান্না, আমাকে টিফিন দেয়া সবই করতেন ।' 'আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার রিলেটিভরা কেমন ?' 'দেখনু স্যার, আমার দিল্লীতে থাকতাম । এখানে মামা বাড়ি তরফের এক দু'জন আছে বলে মাকে নিয়ে শিফ্ট করে এসেছি । কিন্তু রিলেটিভদের তো জানেনই ।' 'হম হম জানি । আপনাকে একটু আমার সাথে আসতে হবে ।' 'কোথায় স্যার ?' 'মন শক্ত করুন ।' 'কেন কেন ? মার কি কিছু হয়েছে ?' 'আসুন মিসেস বোস প্লিজ !' 'স্যার আমি মিসেস বোস নই' 'মানে ? আপনি তো সায়ন্তনের স্ত্রী !' 'কে সায়্ন্তন !' 'আরে ! মিসেস বোস, আপনার পাশের মানুষটাকেই ইগনোর করছেন ? আসুন আসুন, বুঝতে পারছি আপনি ভীষণভাবে বিধ্বস্ত ।' আমি বেশ বিরক্তসহকারে বললাম, 'আমি কোনো সায়ন্তকে চিনি না । আপনি চলুন স্যার । মা কোথায় ?'


অল্প আলোর ঘরে নাকে রুমাল চাপা দিয়েই ঢুকতে হলো । না না আমি যাব না । গেট ধরে বসে পড়লাম । রিন্টুদা আমাকে ধরে নিয়ে বললো, 'যেতে তো হবেই বাবান !' আমি আঁৎকে উঠলাম, বাবান !!! এটা তো বাবা ডাকতো ! 'না গো আমি যাব না ! প্লিজ ... প্লিজ !' কিন্তু চোখে জল এলো না । রিন্টু দা আমাকে ছেড়ে রেখেই সনাক্ত করতে গেল । এসে বললো 'ওঠো, কাকিমা নন । চলো সাইন করে বেরিয়ে যাই ।' অন্ধের যষ্ঠির মতোন রিন্টু দার হাতটা ধরলাম । সাইন করেই গাড়িতে উঠে প্রথম প্রশ্ন করলাম 'তুমি কে ?' 'কেন ? আমি রিন্টু !' 'না না, সায়ন্ত কে ?' 'সেও আমি !' 'why আমি মিসেস সায়ন্তন ?' 'আরে ! ইগনোর ইগনোর' । 'না', বেশ জোরেই বলে ফেললাম 'ইগনোরের কিছু না, নাটকটা কী শুনি ! আমি কবে তোমার ওয়াইফ হলাম ?' 'আরে বললাম তো ইগনোর !' 'না' - বেশ রাগত স্বরেই বললাম । পরিস্থিতি বুঝে রিন্টু দা বললো ' আচ্ছা চলো কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করে কথা বলি ?' 'কোনো ঠান্ডা গরম না, এখানেই বলো । stop the car immediately !' 'আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হও । selfish giant @gmail .com মনে পড়ছে ?' আমি তো থ ! 'তুমি !!! সেলফিস জায়েন্ট !' 'হুম আমিই ।' 'মানে, তুমি তো রিয়াধে থাকতে ।' 'হুম, থাকতাম । তবে অস্বথমা হতো ইতি গজ' 'বুঝলাম না' 'অনেক ইতিহাস, তবে এখানে বসে না থেকে একটু ঠান্ডা হওয়া যাক !' আমি কোনো কথা বলার অবস্থায় ছিলাম না । শুধু মিসেস সায়ন্তন বোস কে বোঝার চেষ্টা করলাম । ...

“চার”


হাই, হ্যালো করে প্রথম পরিচয়টা বেশ ভালোই সারলাম । সেলফিশ জায়েন্টের সাথে কথা বলতে মন্দ লাগছে না । বেশ ইন্টেলিজেন্ট বলেই মনে হচ্ছে । আইডিটাও বেশ । অবশ্য তথাকথিত অনলাইন ফ্লার্ট করছে না । খুব ফ্লুয়েন্ট সিম্পল লাইভলি কনভারসেশন । মেন্টালি ম্যাচ করছে দেখেই এতক্ষণ হ্যাজাচ্ছি । যাই কাল আবার কথা হবে । সেলফিশ জায়েন্ট কিন্তু বেশ । এরকম করে বেশ কয়েক মাস কথা বলছি । কিন্তু ওদিক থেকে কোনোদিন অকারণে অবান্তর কথা উচ্চবাচ্য করেনি । মন্দ লাগছে না । গড়পড়তা ছেলেদের মত না । তাই হয়তো অনলাইন হলেই কথা বলি । বাবা মা সবার খোঁজ নেই । আবার বলে ও নাকি আমাকে চেনে । জানি ওটা পুরোটাই ন্যাকামো । তবে ঘাটাঘাটি করতে ইচ্ছে নেই । বলেছে ও নাকি এবার ছুটিতে আসছে দেখা করবে । অদ্ভুত ব্যাপার কোনোদিন আমাকে একবারো বলেনি ভিডিও কল করতে বা ফোটো শেয়ার করতে । বেশ অন্য ধরনের । আমিও বিন্দাস ফ্লার্ট করছি । কলেজের সেকন্ড ইয়ারে কার না এসব ভালো লাগে ! গ্যাস ওভেন থেকে ভাতের ফ্যান কখন পড়ে তল ধরতে শুরু করেছে ! সেটা খেয়ালও হয়নি ।

ফোনটা বাজাতে হঠাৎ ঘোরটা কাটলো । আননোন নাম্বার - "হ্যালো, আচ্ছা নিবেদিতাদেবী কি আপনার মা ?" "হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন আমি ওনার মেয়ে বলছিলাম । কী হয়েছে মার ? আপনি কে বলছেন ? উনি ঠিক আছে তো ?" "আস্তে আস্তে, আপনি শান্ত হোন । আমি অভিজিৎ কর্মকার । দামদাম মেট্রো স্টেশন থেকে বলছি । আপনি একটু আসুন ।" আমি আর কিছু জিজ্ঞেস না করে গ্যাস বন্ধ করে গেটে তালা লাগাতে লাগলাম । কিন্তু রাত তো বেশ হলো ! যাব কীভাবে ? হাতে ফোনটা নিয়ে সবে ভাবছিলাম, ঠিক সেই সময় দেখি একটা খালি ট্যাক্সি বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে । "ভাইয়া রোকো রোকো ভাইয়া !" দৌড়ে কোনোমতে ট্যাক্সিতে উঠলাম । "জলদি চলো দামদাম মেট্রো" "ঠিক হ্যায়" আমিও হেলান দিয়ে বসলাম । আজ যেন বাবার রিপোর্টটা ভালো আসেনি । আরো ডেটোরিয়েট করেছে । কিন্তু মনের জোর প্রচন্ড । "তোমার কোনো চেনা ডক্টর আছে ?" "আছে তবে কাকুর রিপোর্টগুলো পারলে আমাকে স্ক্যান করে পাঠিয়ে দাও । আমি এখানে একবার দেখাই । আচ্ছা শোনো, তুমি বলেছিলে না তুমি আসবে ? কবে আসবে ?" ...

কখন যে নির্ভর করতে শুরে করেছি ঠিক জানিনা । অজান্তেই একটা বলিষ্ঠ অদৃশ্য কাঁধ আমার মেরুদন্ড হয়ে গ্যাছে । "হুম যাব ছুটি পাচ্ছিনা । শিফ্ট করবার চেষ্টা করছি" । সব কথাগুলো পরিষ্কার । কিন্তু হঠাৎ কিসের জন্য কথাতে দাড়ি পড়ছিল ঠিক এখন মনে পড়ছেনা । বাবা তুমি থাকলে আজ আমি এতটা একা হতাম না । "দমদম স্টেশন আ গ্যায়া" । আমি ট্যাক্সিওয়ালাকে মিটার জিজ্ঞেস করে টাকা মিটিয়ে আর খুচরোর অপেক্ষা করলাম না । ছুটে টিকেট ঘরের কাছে গিয়ে রিসিভড নাম্বাএ ফোন করলাম । "হেলো ! আমি এসে গেছি অভিজিৎ বাবু । মাকে তো দেখতে পাচ্ছিনা ।" "না না উনি এখানে নেই । আপনি তো পুরো কথা শুনলেন না । তার আগেই তো ফোনটা কেটে দিলেন ।" "স্যরি স্যরি আসলে মাথার ঠিক ছিল না । বলুন আপনি কোথায় যাব । মা কোথায় ?" "আপনি ব্যস্ত হবেন না স্বস্তিকা !" "আপনি আমার নাম জানেন ?" "হমম নিবেদিতা দেবী বলেছেন ।" "ওহহ ! বলুন আছে কোথায় ?" "হমম বলছি আপনি দেখুন স্টেশনের বা দিকে কিছু অটো দাঁড়িয়ে। অটো ধরে নগেন ঘোষ লেনে চলে আসুন । ৮ টাকা নেবে অটোওয়ালা । আমি রাস্তার মোড়েই দাঁড়িয়ে ।" "আচ্ছা আচ্ছা" দূরে অটোস্ট্যান্ডে গিয়ে অটোতে বসে বললাম 'দাদা নগেন ঘোষ লেন যাব' "এত রাতে ?" অটোওয়ালা একবার জিজ্ঞেস করলো । আমি বললাম " হমম দাদা প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি চলুন । বিশেষ দরকার আছে ।"

“পাঁচ”


সর্ব শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা । মুখ হাত বাঁধা । জ্ঞান পুরোপুরি ফেরেনি । চিৎকারটা মনে আছে শুধু, আর মনে আছে নিজের নাম । বাকিটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে । চোখ দিয়ে জলটা যেন আজ ভীষণ নোনতা । সেলফিশ জায়েন্ট বলে একবার ডাকতে ইচ্ছে করছে । কিছু বোঝার আগেই আমাকে ঝুলিয়ে দিল ফ্যানের সাথে । প্রাণটা আছে কিনা আমি জানিনা । তবে দরজা যে কেউ ভাঙছে সেটা খুব পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি । বাবান বাবান এটা আমার সেলফিশ জায়েন্ট । আহহহ আমি বেঁচে আছি ! এই তো জড়িয়ে ধরবো একবার । আজ কাঁদবো । অনেক কথা শেষ হয়নি । আজ বলবো একবার জড়িয়ে ধরবো । বাবান... বাবান.... বাবান প্লিজ কিছু বলো প্লিজ ! এইভাবে শেষ হতে দেব না । প্লিজ একবার বলো - আরে আমি তো আছি, এই তো তুমি কি বুঝতে পারছ না রিন্টু দা ! আমি জড়িয়ে ধরতে চাইছি । একটু কাছে এসো ...

'বড্ড জেদী তুমি, এতবার করে বললাম একবার ছবি পাঠাও ! পাঠাব পাঠাব করেও দাওনা । কারণটা কী শুনি ? দেখতে ভালো না ? নাকি মিথ্যে বলে চ্যাট করছো ? বয়স বেশি ? কারণটা কী শুনি ? আজ হেস্তনেস্ত না করে ল্যাপটপ ছাড়ছি না ।' কথা শুরু হয়েছিল নটায় । এখন প্রায় দেড়টা । এ কথা ও কথা, কত কী সারারাত হলো ! গুড নাইট বলে উইন্ডোবক্সটাও বন্ধ কে দিলাম । কিন্তু আজব ব্যাপার আজও ভুললাম ছবি দেখতে । 'বাবা নেই জানো ! সত্যি বলছি আর বাবাকে দেখতে পারবো না' 'কবে কাজ ?' ওদিক থেকে প্রশ্ন আসলো । 'আজ চতুর্থীর কাজ শেষ করলাম । কিন্তু আমি ১১ দিনের কাজও করবো । ছেলে নেই তো কী হয়েছে বলো ! আমিই তো ছেলে" "হুম মধ্যে প্রায় ১০..১২ দিনের একটা গ্যাপ" । কথা হয়নি, সব মিলিয়ে কেমন যেন নিস্তব্ধ বিরতি । এরকম হয়নি এই এক বছর ধরে । খুলে দেখি মেইল বক্সেও কিছু নেই । এর আগে আমি অনলাইন না হলে মেইলবক্সে নক থাকতো । বেশ কয়েকবার উইন্ডো বক্স খুলে পিংও করলাম । সিন, ডেলিভার্ড দেখলাম । কিন্তু উত্তর এলো না । এরকম করে এক সপ্তাহ কেটে গেল । অস্থিরতা নিয়ে নামি স্যোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে । হাতড়াতে শুরু করলাম । নাম জানিনা, ছবি নেই । আছেশুধু মেইল আইডি । তাই দিয়েই খোঁজা শুরু ।

'স্যার, কিছু করুন প্লিজ । বডি নামাতে দিন । আপনি পেছন সরে দাঁড়ান । আমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটাবেন না প্লিজ ! কো-অপারেশন করুন ।' আমি এবার বুঝলাম, আমি অশরীরি । ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে আমার বিধ্বস্ত শরীর । কিন্তু মনের মায়া আজও অটুট । এখনো অনেক কাজ বাকি । অফিসের ফাইল, নিজের MBA ডিগ্রী শেষ করা । মা , মাকে খুঁজে পেতে হবে । সায়ন্তন (রিন্টু দা) (সেলফিশ জায়েন্ট) কথা আছে । আমাকে এই ভেবে ছেড়ে দিল কেন ? কথা না বলে ? কথা না বলে কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল কেন ? অজস্র প্রশ্ন ! আহহহ ! আমার লাশটা একটু ধীরে নামাও । দেখতে পারছ না ওরা কাল আমাকে ইঁদূরের মতন খুবলে খেয়েছে ? আচ্ছা, আমি তো এটাও বলে যেতে পারলাম না যে অভিজিৎ কর্মকার আমার ভীষণ পরিচিত সেলফিশ জায়েন্ট । তোমার চেনা মানুষ অভিজিৎ কর্মকার সেজেছিল । মা ও মা আজো কি শেষবারের মতন আমাকে আদর করে দেবে না ? পোস্টমর্টেম শেষ । কাঁচা হলুদ গায়ে মাখিয়েছিল সেলফিশ জায়েন্ট । অনলাইনে যে প্রেমের শুরু হয়েছিল সেটা সূর্যগ্রহণে পুড়ে গেল । কাঁচা হলুদ মেখেও গায়ে হলুদ হলো না । কপালে পড়লো হাতুড়ির আঘাত । মিসেস সায়ন্তন বোস ।

অবিচুয়ারিটা বেশ বড় করে ছবি দিয়ে অনেক পেপারেই ছেপেছে। ছবি দেখে মা যদি ঘরে ফেরে !




পর্ণা ব্যানার্জী সরকার