""এক""
আজকের বৃষ্টিটা তোমাকে ডেকে আনার মতো পড়ছিল।আজকের বৃষ্টিটা গলা ছেড়ে তোমার নাম ধরে ডাকছিল।আজকের বৃষ্টিটা টলটলে সবুজ আঁচল পেতে------তোমার স্মৃতিত ঢেউ তুলছিল।মেঘমল্লারে পাল তুলে দিয়েবৃষ্টির ধারাপাতে রূপসীবাংলার রঙ-তুলি।জল পড়া পাতা নড়া নিঝুম সন্ধ্যামনলিপির সিঁড়িতে তোমারেই এঁকেছিল কেবলই।
ঠিক কি মনের মতো হলো? বৃষ্টির জল ভেজা স্মৃতির ধূসর পাণ্ডুলিপিতে পুরানো ব্যাথায় মনটা আজ সত্যিই ভালো নেই প্রাণতোষের। বাইরে এখনো বৃষ্টির শব্দে মন মাতাল। ভিতরে টেবিল ল্যাম্পের আলো সন্ধ্যা নামিয়েছে অনেক্ষণ! লেখার প্যাডটা নিয়ে মনের মধ্যে একটা চাপা যুদ্ধ চালাচ্ছেন অনবরত। প্রাণতোষ জানেন, এখনই তাঁর সাবধান হওয়া উচিত, নয়তো গতবারের মতো কাণ্ড হয়ে যেতে পারে।
আজ এই সত্তর বছরে এসেও প্রাণতোষ প্রেম ভালোবাসার সঙ্গা খোঁজেন। কিন্তু আজও কি খুঁজে পেলেন? এক এক সময় নিজের ওপরেই ভরসা হারিয়ে ফেলেন। কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা নয়, সব যেন এলোমেলো হয়ে আসে তার। কোনটা ভালোবাসার মুখ, আর কোনটা নয়, কে ঠিক করে দেবে? নিজের জীবনের দিকে পিছন ফিরে তাকালে থৈ পান না আর।
--শুনছো?
রবুর গলা, এখনো গলা ছেড়ে গান গাইলে আগেকার সেই সুর সেই মাদকতা ফিরিয়ে আনতে পারে। শুধু কি গান! সামান্য কথাকেও কণ্ঠমাধুর্য্যে এমন আন্তরিক করে তোলে এই বয়সেও, ভাবা যায় না। কিন্তু না রবুকে লেখাটা দেখতে দেওয়া যাবে না। দেখলেই বকাবকি করবে। তাড়াতাড়ি লেখাটা বইয়ের তলায় চাপা দিতে গেলেন।
--আরে কি লুকাচ্ছো অমন করে? আমার কাছ থেকেও তোমার লুকানোর কিছু আছে নাকি?
খুব সুন্দর করে হাসি ছড়িযে বললেন রাবেয়া।
প্রাণতোষ বুঝতে পারেন, বয়সের ভারে স্লথ হয়ে গেছেন অনেক। দেরী করে ফেলেছেন।। রবুর চোখে পড়েছে যখন একবার তখন আর কোনো উপায় নেই। তাই আর বৃথা চেষ্টা করেন না। জানেন লাভ নেই।
লেখার প্যাডটা হাতে নিয়ে ম্লান হাসিতে চোখ বুলান রাবেয়া। প্রাণতোষের দিকে তাকান। বড়ো মমতাময় সেই দৃষ্টি। প্রাণতোষ চোখ নামান। একটা অপরাধ বোধ কাজ করে মনের মধ্যে। যে মেয়েটা তার শেষ অবলম্বন তাকেই ব্যাথা দিয়ে ফেলেন তিনি। নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না।
লেখার প্যাডটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রেখে, প্রাণতোষের পাশে বসেন রাবেয়া। রবুর শাড়ির ভাঁজ থেকে বেল ফুলের মতো একটা গন্ধ পান প্রাণতোষ। রাবেয়া প্রাণতোষের দুই কাঁধ জড়িয়ে ধরে, ওঁকে বুকে টেনে নেন। বাইরে বৃষ্টির একটানা রিমঝিম শব্দে ঢাকা পড়ে যায় দুজনের শ্বাস প্রঃশ্বাসের প্রগাঢ় শব্দ।
""দুই""
সে রাতে দুজনের কারুর চোখেই ঘুম নেই। প্রাণতোষের বুকে হাতটা রেখে মৃদু স্বরে বলে ওঠেন রাবেয়া, স্মৃতি তো সততই সুন্দর তবে আমরা কেন এত কষ্ট পাই বলো তো?
কিছুক্ষণ কোনো কথা বলেন না প্রাণতোষ। পাশ ফিরে রবুর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।
-- জানি না রবু। জানি না আমি, কি উত্তর দেব তোকে বল? আমি তো সারা জীবনই এর উত্তর খুঁজে চলেছি। আজও তো কোনো সদুত্তরের আভাষও পেলাম না।
গলা ধরে আসে। মনে হয় স্মৃতি ব্যাপারটাই যেন বাজে। বর্তমান, শান্তি দিতে পারে কেবল বর্তমানের মুহুর্ত্তটুকুই, যদি সেটা শান্তির হয়। রবুর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনের জানলায় স্মৃতির ডালপালা ভিড় করে ওঠে।
--আপার কথা কি ভোলা যায় বলো? তুমি যে কেন ভোলার চেষ্টা করতে যাও? আর তাতেই যত কষ্ট পাও।
-- আমি কি ভুলতে চাই রে? না তা নয়, কি জানি মাঝে মাঝে সব কিছু যেন ওলোট পালোট হয়ে যায়।
-- জানি দুলাভাই, তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু যেটার ওপর তোমার হাত নেই, সেটা নিযে যত ভাববে, যত দূরে সরাতে চাইবে, তত সেটা তোমাকে জড়িয়ে ধরবে যে।
-- কি করব বল, তখন ঐরকম ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছিল বলেই না সব ওলোট পালোট হওয়া শুরু হচ্ছিল, তুই তো জানিস বৃষ্টি দেখলেই তোর আপা কি রকম পাগলামো করতো? কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শটা খুব কাজে দিয়েছে জানিস। ঐ যে যেই লিখতে শুরু করলাম, অমনি আস্তে আস্তে চারপাশটা পরিস্কার হয়ে আসতে থাকল।
--সত্যি বলছো দুলাভাই? রাবেয়া টান টান হয়ে উঠে বসেন।
--তাই তো মনে হলো রে। কি জানি কি হতো, তবে তুই এসে গেলি এক দিক দিয়ে ভালোই হলো।
বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক্ষণ। হয়ত কৃষ্ণপক্ষের রাত। ভেতরের নাইট ল্যাম্পে প্রাণতোষের মুখের দিকে তাকান রাবেয়া। স্পষ্ট বুঝতে পারেন না, শুধু যেন মনে হয়, মানুষটা আজও যেন অঙ্কটা মেলাতে পারছেন না কিছুতেই। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
""তিন'"
আপার হাত ধরে কিশোরী রাবেয়া কলকাতায় পৌঁছে ভয়েই দিশেহারা! এতবড়ো শহর! এত গাড়িঘোড়া! এ কোথায় এলো? সিরাজগঞ্জের খেতুপাড়ার কিশোরীর সেই প্রথম শহর দেখা। খান সেনাদের অত্যাচারের হাত থেকে পালাতে পালাতে এ কোথায় এসে পড়ল? ভয় আর আতঙ্কর দিন রাত্রিগুলোয় আব্বু আম্মুর মুখ মনে পড়ে যত, ততই কান্নাগুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে। আজ যদি আব্বু আম্মু বেঁচে থাকতো, ভাবতে থাকে রাবেয়া। আর তখনই আপার হাতটা আরও শক্ত করে ধরে।
কিন্তু সেই দিশাহারা নগরেই দেবদূতের মতো আবির্ভাব প্রাণতোষের। শরণার্থী শিবিরে সদ্য পাশ করা এমবিবিএস ডাক্তার প্রাণতোষকে কি ভাবে যেন খুঁজে পায় আপা। রাবেয়ার তখন প্রবল জ্বর। সেই সূত্রেই আলাপ আপার সাথে দুলাভাইয়ের। প্রথম দর্শনেই প্রেম। প্রাণতোষের বাড়িতে প্রবল আপত্তি। কিন্তু তবু বিয়ে হয়ে গেল দুজনের। একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় জুটলো দুই বোনের।
আশ্রয়, কে যে কাকে কখন আশ্রয় করে কে বলতে পারে। যত বড়ো হয়েছে রাবেয়া তত বুঝতে পেরেছে কথাটা। সেদিনটাও ছিল আগস্টের পনেরো। চারিদিকে ভারতের স্বাধীনতাদিবসের উৎসব। সেই দিনই রবার্টসনের সাথে পাকাপাকি ভাবে ইংল্যান্ডে চলে গেল আপা। কোনোরকম বাধা দেওয়ার চেষ্টাই করেন নি প্রাণতোষ। খুব রাগ হয়েছিল দুলাভাইয়ের ওপরে সেদিন। মনে হয়েছিল মানুষটার ভালোবাসা বুঝি ফুরিয়ে গিয়েছে। পরে বুঝেছিল ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষটির জন্য আত্মত্যাগ। সে অনেক পরে। কিন্তু আজও বুঝতে পারেনি দুলাভাইয়ের মতো মানুষকেও কি করে ফেলে চলে যেতে পারল আপা। রাবেয়া বোঝেন, প্রাণতোষও সে কথা বুঝতে পারেন নি আজও। কিন্তু আজও প্রাণপনে বোঝার চেষ্টা করেন। আর তাই তো, মেন্টাল ব্রেকডাউন হয়ে যায় কখনো সখনো।
প্রাণতোষের রোগটা প্রথমে ধরা পরেনি। এমনকি বিলেতে মোটর দূর্ঘটনায় আপার মৃত্যুর প্রথম দশ বছরেও নয়। কিন্তু প্রায়ই আক্ষেপ করতেন, সেদিন যদি স্ত্রীকে বাধা দিতেন, তবে অকালে প্রান হারাতে হতো না। তখনই নিজের ভালোবাসাকেই কাটাছেঁড়া করতে বসেন প্রাণতোষ। চিকিৎসকদের মতে সেইটাই নাকি তার মেন্টাল ব্রেকডাউনের কারণ।
""চার""
ভোররাতের দিকে তন্দ্রা কেটে যেতেই চমকে ওঠেন রাবেয়া ঘর খালি। প্রাণতোষ বরাবরই একটু বেলা করে ওঠেন। এত ভোরে তো তাঁর ঘুম ভাঙার কথা নয়। আর তখনই প্রাণতোষের গলা পান বারান্দা থেকে। আবার আপার সাথে কথা বলতে শুরু করেছেন। এবার এট্যাকটা একটু যেন তাড়াতাড়িই হলো দুলাভাইয়ের। আবার আপার হয়ে তাকেই প্রক্সি দিতে হবে কদিন, যতক্ষণ না সম্বিত ফেরে প্রাণতোষের।
===শ্রীশুভ্র**
(১৫-০৮-২০১৪)