মিমির মিনিগল্প ~ সাঈদা মিমি



পত্রমিতা

---
আমরা তিন বন্ধুই যখন অপুর প্রেমে পড়লাম, তখন প্রাথমিক একটা ভাবনা এসেছিলো মাথায়, কিভাবে কি? কিন্তু ,আমাদের বন্ধুত্বে মোটেই চিড় ধরলো না আমরা স্বিদ্ধান্ত নিলাম, অপু কে তিনজনেই বিয়ে করবো সপ্তাহে দুইদিন করে ও আমাদের হবে এবং একদিন তার ছুটি বিষয়টা অপু কে জানানোই হলো না, কত কি পরামর্শ বাকি! বন্ধু থেকে সতীনে প্রমোশন, একই বাসায় সবাই থাকা ঠিক হবে কিনা? মন কষাকষির ব্যাপার তৈরি হতে পারে সন্তান নিতে হবে মাত্র দু'টি, কে স্যাক্রিফাইস করবে সেটা আগেই ঠিক করে ফেলতে হবে ইত্যাদি কিন্তু, অপুর পরিচয়? সে আমাদের পত্রবন্ধু, স্পেনে থাকে

প্রথমে সে নেলীর বন্ধু ছিলো তারপর তার রূপ ও লেখনীতে মুগ্ধ হয়ে আমি আর হাবিবা অপুর পত্রমিতা হলাম সে আরেক ধোঁয়াশা, অপু জানতেও পারলো না! আমরা তিনজন পরস্পরের বাল্যবন্ধু, প্রাইমারী স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত একই সঙ্গে চলছি এতে সুবিধা হলো এন্তার, অপু আমাদের লেখে, আর আমরা তিনজন মিলে ভাগাভাগি করে পড়ি তার লেখায় ভাবাবেগ থাকে, প্রেম, যৌনতা, স্বপ্ন এবং আমরা ক্ষেপে উঠি, একসঙ্গে তিনজনকে খেলাচ্ছে! 'বোঝাবো তোমাকে, দেশে এসো, নয়বার কবুল উচ্চারণ করতে হবে '

এসব নিয়ে আমরা মস্করা করি, গম্ভীর হই, পরিণতি ভাবি তারপর হাবিবার ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয় কিসের মধ্যে কি? হাবিবার ভাই আবার কেনো মঞ্চে! আছে, আছে, বেচারার বৌ স্পেনের নাগরিক বিয়ের পর ওরা সেখানে চলে যাবে হাবিবা তার ভাইয়ের কাছে অপুর ঠিকানা দিয়ে দেয়

পরের তিনমাসে অনেককিছু ঘটেছে, আমরা থার্ড ইয়ারে পা রেখেছি পড়ার চাপ বেড়েছে, বাবা-মা হুঁশিয়ারী বার্তা পাঠিয়েছেন, কোনক্রমে রেজাল্ট খারাপ হলে প্রশ্ন ছাড়াই বিয়ে দিয়ে দেবেন এরমধ্যে এলো শিপনের চিঠি, সঙ্গে বিরল ছবি শিপন হচ্ছে হাবিবার ভাই অপু কে বের করে ফেলেছে সে, কালোকুলো মতন এক দাঁতউচু মেয়ে, যার নাম অর্পণা পাশের বাড়ির ছেলেটার ছবি দিয়ে দিব্যি ছেলে সেজে আমাদের ঘোল খাইয়েছে হাবিবা বললো ইয়াক, আমি বললাম ওয়াক, আর নেলী হড়হড় করে বমি করে দিলো
সাঈদা মিমি

মৌমাছি ও বাংলা ভাষা

-------------

হিমিকা বললো, ঢিলা মার। আমি গা করলাম না, তুই মার আমার দুই হাত বন্ধ, দেখছিস না! সুতায় মাঞ্জা দিচ্ছি। তাও ঠিক, ডাবলু সিঁড়িঘরের কাছে ঘুড়ি বানাতে ব্যাস্ত, মৌলি গেছে চানাচুর বানিয়ে আনতে, পাশে আছে পাপ্পু। ওকেই বললাম, তুই মার না ঢিলাটা, আমার গা শিরশির করছে মৌচাকে! আমি!! ঢিলা!!! পাপ্পু একটা শয়তানি চাউনি দিয়ে ভেগে গেলো

আমার নানাবাড়ির ছাদে বিষ্যুদবার, দুপুরের গল্প, সবাই একসাথে হয়েছি এবার ঘুড়ি ওড়ানোর খেলায় নেপলাদের দল কে হারাতেই হবে ছাদটা অপূর্ব! জমিদার নীরুনাথবাবু দেশভাগের সময় কোলকাতা চলে যান, আমাদের নানাদের ভবানীপুরের বাড়ির সাথে এই বাড়িটা অদলবদল করে ভবানীপুর কোথায়? আমায় জিজ্ঞেস করবেন না, আমি মোটেই চিনি না তবে নানা কে প্রায়ই উদাস হয়ে ভাবতে দেখি, বলতে শুনি, এইবাড়ির মতই বিশাল আর সুন্দর ছিলো সেই বাড়ি ছাদঘরে ছিলো চিলেকোঠা, নানার নিজের কামরা ছিলো ওটা আজকাল বড় বেশি ভাবেন নানা! প্রশ্ন করলেই বলেন, আমার মত বুড়ো হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে তোরও ফেলে আসা দিনের কথা মনে হবে

আমার মামার শালা একটু গুণ্ডা প্রকৃতির, এখানেই বেশিরভাগ সময় থাকেন, কোন কলেজে নাকি পড়েন আমি তো পড়তেই দেখি না! বেলি খালার ননদ অবন্তী খালা বেড়াতে এলে, তাদের এই ছাদের চিলেকোঠায় দরজা বন্ধ করে থাকতে দেখি মা কে একবার বলেছিলাম, মা আমাকে শাসিয়েছেন, এই খবর যেনো দুইকান না হয় বড় হওয়াটা নিশ্চই রহস্যময় কোনো ব্যাপার! আমার বড় হতে ইচ্ছে করে, এই চারদেয়ালের বাইরের আদিগন্ত পৃথিবী দেখার ইচ্ছেও হিমিকা আবারও তাড়া দিলো, মৌচাকে ঢিল মার নিশু কেনো? ওরা কি তোকে কামড়াচ্ছে? ছাদঘরে বাসা বেঁধেছে কেবল মার বলছি, দুই একটা উড়ে আসছে এদিকে হূল বসালে! অনেক ব্যথা

মারলাম কয়েক সেকেণ্ড বিরতি, তারপর কালো একঝাঁক উড়ে এলো এদিকে মা গোবলে আমিতো ছাদে উপুড় হয়ে পড়েছি কিন্তু একি! হিমিকা পাড়ার ক্ষেপা ষাঁড়ের মত সমানে চিৎকার করছে । মাথা তুলতেই দেখি, মৌমাছির দল ঘিরে ধরেছে ওকে, কেউ কেউ হূল ফুটিয়ে যাচ্ছে সানন্দে ততক্ষণে নিচে খবর পৌঁছে গেছে আগুন আর মালসায় কয়লার ধোঁয়া নিয়ে হাজির হয়েছে সবাই ঢিল তো আমি মেরেছিলাম! হিমিকা কামড় খেলো কেনো!! আমার কাছেও ওরা আসেনি!!! তবে কি ওরা মানুষের ভাষা বোঝে? আমি ঢিল মারতেই চাইনি, হিমিকা আমাকে বাধ্য করেছিলো!

নীতিকথা: জানতিস আছে হূল/ কেনো বাপু এই ভুল করলি হিমিকা? 
ফুলে ঢোল! বেঁচে গেলি, এইটাই আশা
 
আমারও শিক্ষা হলো, _সূযোগে জানলাম, মৌমাছিরাও বোঝে বাংলা ভাষা!
সাঈদা মিমি

বাবুসোনা পাঠাধর



তেনাকে আমি চিনতামই না, একদিন আমার রিকসাওয়ালাকে এক রদ্দা মেরে বলেছিলো, শালা চিনিস আমাকে? না দেখে চলিস, সাহস কত! সেই প্রথম তার চেহারা চিনলাম । রিকশার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকটা কে বাপু? পোকায় খাওয়া দাঁত বের করে সে জবাব দিলো, হেরে চেনেন না! মস্ত লোক, সাইত্য হরে । এবার আমার আঁতকে ওঠার পালা, সাহিত্য করে? খাইছে, কয়েকদিন আগে কবিতা করার অপরাধে পুলিশ একজনকে ধরে নিয়ে গেছে! এবার এই সাহিত্য করা পাবলিকের হাত থেকে বাঁচার জন্য রিকশাওয়ালাকে বললাম, যত জোরে পারিস প্যাডেল মার । আমার বুক ধড়ফড় করছে । 

তাকে দ্বিতীয়বার দেখলাম চৌমাথার বখাটে আসরে । পাড়ার ছেলেরা ফুলের মালাসহ কি যেনো এক রসময় গুপ্ত পুরস্কারে প্রধান অতিথি করেছে । তখন নামটাও জানা হলো, বাবুসোনা ননীধর । এতগুলা বিশেষণযুক্ত নাম! আগ্রহ হচ্ছে, দেখি না একটু! কে যেনো বলে উঠলো, এইবার নুনুধর সাইবে বরকিতা দিবে । ভীড়ের মধ্যে রসিক মন্ত্যব্যকারীকে দেখতে পেলাম না । ননীধর সাহেব মঞ্চে এলেন, প্রিয় বন্ধুগন, একরাতের মধ্যে আমার লেখা উপন্যাসসোহাগীর সোহাগরাতহিট । আপনারা জানেন, ‘বাসরযাপনের ছলাকলালিখতে আমাকে দুইটা বাসর উদযাপন করতে হয়েছে । কিশোরপ্রেম ও ঢলাডলি আমার প্রিয় উপন্যাস । বোরকার আড়ালে লিখতে সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে, ছয়মাস । এখানে গবেষণার বিষয় ছিলো……. অতঃপর আর ধৈর্য রাখা সম্ভব হলো না ।

বাবুসোনা ভাই কে আবিষ্কার করলাম আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে । হ্যাঁ, তৃতীয় দর্শন ।
-আপনি এখানে?
-আইন পড়তে আসছি ।
-এই বয়সে! পঞ্চাশ তো হবে নিশ্চই!
-এইসব কি বলেন? চল্লিশ পার হয় নাই । আর বটবৃক্ষের আবার বয়স!
-আপনে তো এটিএম সামসুজ্জামানের ডায়ালোগ মেরে দিলেন!
-আরে, ওইটাই তো আমার কাজ, আমি কাটপিসে জোড়া দেই…. বলতে বলতে তিনি আমার আরও কাছে এগিয়ে আসতে থাকেন । প্রথমে কাঁচা রসুন, তারপর পাঠার গন্ধে চারপাশ ভরে ওঠে । দৌড় দেবার পর আমার বোধোদয় হয় এবং একটি নীতিবাক্য জন্মলাভ করে ।

নীতিবাক্য: কাঁচারসুন গিলিয়া খাইবেন । পাঠাসঙ্গ হইতে সাবধান, বাংলা সাবানেও ফেইল ।

সাঈদা মিমি

স্বগতোক্তি

এভাবে জ্বালানোর মানে কি? না ঘুম, না জেগে থাকার মাঝামাঝি এসে বসে থাকো! আমার মেহগনীর আরাম চেয়ারে নয়তো সিথানের কাছে! স্বপ্ন হলে তোমাকে ছোঁয়া যেতো, নির্ঘুম থাকলে তুমি স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস হতে, কিংবা চক্ষুজল আমি তোমাকে আবাহন করিনি, তোমার কথা ভেবে সকাল এসে যাওয়া রাত, তা ও হারিয়ে গেছে তেইশ বছর আগে কেনো আসো? কি চাও? আমি প্রার্থনাসভায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি

ভালো গাইতে পারতে, জানি তো! তাই বলে ওই গানটাই কেনো গাইতে হবে বারবার? ‘এই নীল মনিহার, এই স্বর্ণালী দিনে!’ আমি সবই মনে রেখেছি, ঘৃণা, করুণা এবং ভালোবাসাও কিন্তু আমার সিথানে তোমাকে চাই না, প্রিয় চেয়ারেও না যে দিন মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে, তার গল্প আমি কীর্তনখোলা কে জানিয়ে এসেছিআমার ভাঙাচোরা ঝড়, কালিজমা চোখের জল, স্বপ্নের পুতুলবাক্স, ডাকে পাওয়া চিঠি, তোমার দেয়া সব উপহার, নীল মলাটের ডায়েরী, আমাদের ছবিগুলি, সব কীর্তনখোলা বুক পেতে নিয়েছে তুমি মুক্তি দিয়েছো, আমি মুক্ত হয়েছি তারপর এত টান কিসের?

আমার ঘুম ও জেগে থাকার সময়গুলো দীর্ঘায়িত হতে থাকে দয়া করে একটু ঘুমাতে দাও, অনেকবছর আমি নির্মল কোনো ঘুম দিতে পারিনি! সম্ভবত এসব শুনেই মুচকি হেসে চলে গেলো হিয়া কিছু বললো না, প্রশ্নবিদ্ধ কোনো চোখে তাকালোও না শেষবার তাকে দেখেছিলাম নীল সাদা পোষাকে, মৃত্যু তাকে অমর করার ও অনেক বছর আগে
সাঈদা মিমি

ঈমাম খসরু মতিয়ার

----
বিকেলটা নদীর পাড়েই ভালো জমে ওঠে কৃষ্ণচূড়ার নীচে সবাই গোল হয়ে বসি, বহুব্যবহৃত তাসের বাণ্ডিল পাশে থাকে, হাসু মামা এলে খেলা শুরু হবে পালগোদা; বড়রা বলে ভাউরা মরদ মুচড়ানো ঘাসের ওপর বসে রূপালী ফিতার মত নদী দেখা যায়, হেলেদুলে পশ্চিমের কোথাও চলে গেছে পাম গাছগুলি শেষ হতেই বাবলার ঝাড়, ফুল পাতারা উড়ে আসে বাম দিকে, বেলু মিয়ার দীঘি পাড়ে আকনের জটলা আর চোরাকাটা, স্থানীয়রা বলে, ছিনাল কাঁটা জবুথবু হয়ে থাকা খেঁজুর গাছগুলির মধ্য থেকে আমরা নির্বাচন করে রাখি, রাতে কোন কোন গাছ থেক রস চুরি করা হবে

হাসু মামা আসার পর খেলা শুরু হয়, একদল দেখে, 'এই দিলাম তর রুইতনের টেক্কা খাইয়া' -এ ঠিক না মামা, আপনে চিটিং করছেন, সাইড অফ জানান দেন নাই -নিয়ম আছে নাকি? কিল্লিগা জানামু? এমন সময় ঈমাম খসরু মতিয়ার সাহেব কে দেখা যায়,- কি করতাছস তরা? -জ্বি হুজুর মোনাজাত করি... ট্যাটন সোরাব জবাব দেয় হারামজাদা, আল্লাবিল্লা নাই, হারাম কামে ওস্তাদ! মাঝপথে হস্তক্ষেপ করতেই হয়, নইলে অনর্থ হবে

-হুজুর শুনছি, আপনের মজ্জিদে জ্বিন আছে! হাচা?
-
হ আছে, তুই কেমনে দেখবি! নারীজাতির মজ্জিদে যাওয়া নিষেধ
-
নিষেধ! আপনেরা কত সহজে পুরুষে পুরুষে কোলাকুলি করেন, নারী পুরুষ কেন পারে না!
-
কে কইছে পারে না?
-
কেমনে?
-
ইস্পেশাল কিছু নিয়ম আছে
-
বুঝিনাই
-
একবার নবীজি সাহাবীদের নিয়া বসে ছিলেন, এইসময় এক রূপবতী নারী সেইখানে আসলে নবী তাকে আলিঙ্গন দিয়েছিলেন
-
তওবা, তওবা, এইটা কি কইলেন!
-
তুই কি বুঝবি? সে নারী ছিলো না, ছিলো নারীর প্রতীকে দুনিয়া
-
মানতে পারলাম না, জীবন অনন্ত নয়, নবীজি দুনিয়া কে কেনো আলিঙ্গন দিবেন!

ঈমাম সাহেব একটু বিপাকে পড়ে যান, তার বাবড়ি চুল দোলে, মার্কসীয় দাঁড়ি কাঁপে সম্ভবত, নিজের ইচ্ছার কথা নবীজির নাম দিয়ে বলে ফেলেছেন! তিনি বিব্রত হয়ে উঠে পড়েন 'মগরিবের সময় হইয়া আসতেছে, ঘরে যা পাপীর দল ' ঈমাম সাহেব প্রস্থান করতেই হাসু মামা বলে ওঠেন, 'শালা, চুতিয়া ' -মুখ খারাপ করেন কেন মামা? -দেখলি না, নবীজির বরাত দিয়া কি নিকৃষ্ট কথা বইল্লা গেলো! বেশরম কাজেরবেডিখোর -এরকম বকা তো আগে শুনি নাই! কাহিনী কি মামা? হাসু মামা কিছু না বলেই চলে যান বাবলার ঝাড়ে সন্ধ্যা, সোরাব বলে উঠলো, হুজুরের নয়া বাদীটার চারমাসের পেট খসাতে গিয়ে জীবন সংকট দেখা দিয়েছিলো তার স্ত্রী চলে গেছে, হুজুর পাত্রীর সন্ধানে আছেন নাহ, বিকেলটাই মাটি, কে যেনো চিমটি কেটে গেলো! রাইতভর ঘুমাইলে আন্ধারপোকাদের দেখবা কেমনে!
সাঈদা মিমি