লাভ এট ফার্স্ট সাইট। হ্যাঁ একে তাই নিশ্চয় বলবে প্রিয়া। গত ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে দু তিনজন বান্ধবী নিয়ে প্রিন্সেপ ঘাটে গিয়ে বেশ একটু হুল্লোড়ে মেতে ছিল সে। এই তিনজনের কোনও ভালবাসার লোক নেই। মানে এখনও পায় নি। এই ভালবাসার লোক বলতে প্রেমিক আর কি।
বাকি দুজন এত কেয়ার করে না তার জন্য। কিন্তু প্রিয়ার মনটা যেন কেমন হু হু করে।
শ্রীমিতা বলল, দুঃখ করিস না প্রিয়া, ধর না আমরা তো একে অন্যের জন্যেই নাকি?
রুমনা বলল, দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে ভাই। প্রেমিক আর বন্ধু এ দুটো কি আর এক জিনিস বল? বলে বেশ জোরে হেসে উঠেছিল। বেশ সুন্দর হাসতে পারে সে। আর কি সুন্দর গলা তার। যেন রিনি রিনি করে একটা এসরাজ বেজে উঠল।
ওরা তখন গঙ্গার ঘাটে বসে গঙ্গার শোভা দেখতে ব্যস্ত। নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে কত কিছু। তুচ্ছ খড়কুটো, কচুরি পানা, পুজোর ফুল থেকে শুরু করে বড় বড় স্টীমার নৌকো লঞ্চ। যেন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ওই স্রোতের মধ্যে। সাঁতার কাটতে ইচ্ছে হয় কারোর হাত ধরে ধরে। চলে যেতে ইচ্ছে হয় সেই মোহানা পর্যন্ত। কিংবা আরও আরও দূরে। সমুদ্রের একেবারে গভীরে।
এমন সময় ফুচকার নেশা পেয়ে গেল ওদের। বাকি দুজন হুড়মুড়িয়ে উঠে গেল ফুচকাওলার দিকে। কিন্তু প্রিয়ার যেন উঠতে ইচ্ছে করে নি। স্রোতের সঙ্গে স্রোত হয়ে ভেসে যেতে তার খুব ভাল লাগছিল।
- এই প্রিয়া আয় শিগগির। ফুচকা ঠান্ডা হয়ে যাবে। দূর থেকে চেচিয়ে ডাকল শ্রীমিতা।
- এই ফুচকা আবার ঠান্ডা হয় নাকি? বলে আবার সেই জলতরঙ্গটার মত খিলখিলে হাসি হাসল রুমনা।
নাচার প্রিয়া উঠতে গেল। আর উঠতে গিয়েই লক্ষ পড়ল ছেলেটার দিকে। কত বয়েস হবে বড় জোর চব্বিশ কি পচিশ। কিন্তু কি দৃপ্ত যৌবন। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ পেয়ে বসল তাকে।
ছেলেটাও দেখেছিল। কি সুন্দর মিষ্টি হাসছে। হ্যাঁ তাকে দেখেই তো। কিন্তু একে তো কখনও দেখে নি। হতে পারে ইউনিভার্সিটিতে হয়ত আগের ক্লাসে পড়ত। তার মুখ হয়ত চিনে রেখেছে কিন্তু প্রিয়া তো চিনতে পারছে না।
ছেলেটাই এগিয়ে এল, হাই!
ভারি সুন্দর হাসিটা। সুন্দর করে হাসল প্রিয়াও। কিন্তু কেমন একটা জড়তা তাকে পেয়ে বসেছে। কেমন শিরশির করছে তার গায়ের লোমগুলো। তাকাতে একটু লজ্জা করছে আবার না তাকিয়েও থাকতে পারছে না। আড়চোখে তাকাতে লাগল। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল।
-হাই! প্রত্যুত্তর দিল প্রিয়া।
-বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছ বুঝি? ছেলেটা বলল, ভি-ডে সেলিব্রেয়াশন?
-আপনি মানে –
-আবার আপনি কেন? আমি জয়। জয় সেনগুপ্ত। জুলজি টু থাউজেন্ড থারটিন ব্যাচ সি ইউ। তুমি তো এখনও পড়ছ? ফিজিওলজি সেকেন্ড ইয়ার – করেক্ট?
স্মৃতি অনেক হাতড়ালো প্রিয়া। জুলজির জয় সেনগুপ্ত বলে কাউকে খুঁজে পেল না। ওদিকে রুমনা আর শ্রীমিতা জোর তাগাদা দিয়েছে। প্রিয়ার কিন্তু খুব থাকতে ইচ্ছে করছে। আর দুটো কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
-ওকে, বাই। ছেলেটা বলল হেসে, তোমার বান্ধবীরা তোমায় ডাকছে।
-কিন্তু –
প্রিয়ার গলাটা বেশ অসহায় লাগল।
আর কটা পা এগিয়ে এল জয়। গলা বেশ নামিয়ে বলল, আমি কিন্তু বোধহয় তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। মনে হচ্ছে লাভ এট ফার্স্ট সাইট।
বুকের ভেতরটা যেন কেমন কেমন করছে প্রিয়ার। কি করে জানল তার মনের কথাটা? তবে কি সত্যি এটা লাভ এট ফার্স্ট সাইট? প্রবল একটা উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে।
যেন পালাতে পারলে বাঁচে এমনি অবস্থা প্রিয়ার। বান্ধবীরা তো হেসেই অস্থির। রুমনা বলল, ছেলেটা কে রে?
-ধ্যাত কোন ছেলেটা?
-ওই যে তোর সঙ্গে কথা বলছিল? রুমনা বলল।
-কেউ নয়। যেতে গিয়ে গায়ে একটু লেগে গিয়েছিল বলে সরি বলল।
-শুধু সরি বলতে লাগল এতক্ষন?
শ্রীমিতা দুষ্টুমি করে বলল, ও আবার তোর বুকে এসে পড়েনি তো?
রুমনা বলল, বুকে না হলেও হৃদয়ে তো বটেই। দেখছিস না কেমন এক্সাইটেড?
-ফাজলামি হচ্ছে, না? প্রিয়া খুব বিরক্ত, আমি কিন্তু চলে যাব তবে।
শ্রীমিতার দুষ্টুমি আর যায় না। বলল, কার সঙ্গে রে? ছেলেটার সঙ্গে?
দিনটা সেদিন ভালই কাটল প্রিয়ার। তবে মাথা থেকে জয়ের চিন্তা আর দূর হয় না। সত্যি তো এ নিশ্চয় লাভ এট ফার্স্ট সাইট। মাথার মধ্যে অনবরতই ঘুরপাক খাচ্ছে কথাটা।
একটা ফোন নম্বর দিয়েছিল জয় ওই সামান্য সময়ের মধ্যেই। সবকিছু বেশ খেয়াল রাখে তো ছেলেটা। দারুন গেঁথে গেল প্রিয়ার মনে। সত্যি এটা যদি সত্যিই লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয়? হাত পা তার যেন কাঁপছে উত্তেজনায়।
ভি-ডে থেকে মাত্র তো কটা মাস গেছে। ইতিমধ্যে সব তথ্য দিয়ে দিয়েছে জয়। গত ডিসেম্বরে একটা চাকরি পেয়েছে বাঙ্গালোরে। একটা ফারমাসিউটিক্যাল ল্যাবে। কিছুদিনের জন্যে ওকে আবার কোলকাতায় পাঠিয়েছে কোম্পানী। বেশ ভালই হয়েছে। ভি-ডে সেলিব্রেশনটা বেশ মনের মত হয়েছে। তাইতো পেয়েছে প্রিয়াকে। তার প্রিয়াকে।
প্রাইভেট কোম্পানি হলেও বেশ ভাল মাইনে। এখন প্রিয়ার বাবা মত দিলেই হয়।
সোদপুরে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল জয়। বাড়ি মানে ফ্ল্যাট। থার্ড ফ্লোরে একেবারে শেষ দিকে। ঢুকতে একটু গা ছমছম করছিল প্রিয়ার।
চাবি খুলতে গিয়ে একটু ইতস্তত করছে জয়ও।
-কি হল জয়?
-সরি, একটু আগেই মানে আমার বাবা মা আর বোন তিনজনেই এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেছে। আগে জানতাম না। ঢোকার সময় সিকুরিটি বলল। তুমি তখন একটু পেছনে ছিলে। হয়ত শুনতে পাওনি।
চাবি না খুলে দাঁড়িয়ে আছে জয়। খুব দুঃখের সঙ্গে বলল, তুমি বরং অন্য একদিন এস। তোমায় ফিরে যেতে বলতে আমার খুব লজ্জা করছে কিন্তু-
প্রিয়া তো অবাক। একা খালি ফ্ল্যাট। যে কোনো ছেলে তো লুফেই নিতো এ সুযোগ। কিন্তু জয় এত অনেস্ট ভাবাই যায় না। বলল, তুমি সত্যি খুব ছেলেমানুষ জয়। আর খুব ভাল। আমি তোমার খুব প্রশংসা করেছি বন্ধুদের কাছে। ফিরে গিয়ে এর জন্যে আরও বেশী করে করব। আমি কিছু মনে করছি না। তুমি চাবি খুলতে পার। একটু চা-কফি কিছু খাওয়াবে না বুঝি?
কথাটা বলল বটে প্রিয়া কিন্তু বলার পরেই তার একটু ভয় ভয়ও করতে লাগল। জয়ের ব্যাপারে সব কিছুই যে তার জানা তা তো নয়। তারপর আবার নিজেকে এত দুর্বল ভাবার জন্যে রাগ হতেও লাগল। এরকম হলে তো প্রেম করাই যায় না। সকলকেই যদি সন্দেহ করতে হয় তো বিশ্বাস জিনিসটাই উবে যাবে মানুষের মধ্যে থেকে।
ঘরে বসার জন্যে একটাও চেয়ার রাখে নি জয়। হয়ত এটাও তার একটা ফ্যাশান। মানে এই বেডরুমে কোনও চেয়ার বা সোফা না রাখাটা। কিন্তু রয়েছে একটা দারুণ সুন্দর দেখতে খাট। তার ওপরে পাতা দারুন বিছানা। হেঁটে হেঁটে খুব ক্লান্ত প্রিয়া। বসে পড়ল একেবারে বিছানায়। দারুন নরম আর মখমলের মত মোলায়েম। মনে মনে ভাবতে লাগল এ বিছানা হয়ত একদিন তারই হবে। হয়ত এর থেকেও আরও ভাল আরও দামী। কত প্রচুর মাইনের চাকরি করে জয়।
ফ্লাস্ক এনে কাপে কফি ঢালতে ঢালতে জয় বলল, কেমন লাগছে প্রিয়া?
কফি খাওয়া শেষ। প্রিয়া উঠে দাঁড়াল।
-এবার আমায় যদি একটু দিয়ে আস তো-
- ও সিয়োর।
ওই ঘরটা খুব টানতে লাগল প্রিয়াকে। অমন নিরালা ঘর অমন নরম বিছানা ভাবা যায়। আরও কয়েকবার এল সে জয়ের সঙ্গে। জয়ের বাবা মা এখনও ফেরে নি আমেরিকা থেকে। জয়ের বোনের শ্বশুরবাড়ী আমেরিকায়।
জয় একটু ইতস্তত করে বলল, আজ একটু সেলিব্রেশন করলে হয় না?
- সেলিব্রেশন! কিসের?
একটু আবেগঘন হয়ে একেবারে মুখোমুখী দাঁড়িয়েছে জয়। প্রিয়ার মুখের ওপর তার নিশ্বাস। জয়ের গায়ের স্প্রের গন্ধটা দারুন সুইট।
আপত্তি করে নি প্রিয়া। আফটার অল জয়ই তো কটা দিন পরে হবে তার স্বামী। সে বলেছে। একটা বছর তোমায় নিয়ে খুব ঘুরব প্রিয়া। সামনের বছর আমার কোম্পানী আমায় প্রমোশন দিয়ে স্টেটসে পাঠাচ্ছে। বিয়ে করে হনিমুনটা সেখানেই –
সেই হনিমুনের একটা ছোট্ট রিহার্সাল মাত্র। চুপি চুপি রুমনা আর শ্রীমিতাকে বলতে ওরা বলল, বিয়ে যখন করবেই তখন চিন্তা কিসের। তাছাড়া প্রোটেকশন নিয়েছে বললি। কনসিভ নিশ্চয় করবি না।
একমাস পরে একটা খুব খারাপ খবরে চমকে উঠল রুমনারা। সুইসাইড করতে গিয়েছিল প্রিয়া। না, পেটে বাচ্চা আসার জন্যে নয়। ইন্টারনেটে ওর অশ্লীল ছবি সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেওয়ার জন্য।