ঠোকাদাদু - জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

 




তার আস্ত দুটো ঠোঁট তবু নাম 'ঠোঁটকাটা' -- শুনেই প্রতিবাদ করি, কী বলো !  যা হোক নাম দিলেই হলো ! সে অনেক বছর আগের কথা। দাদু বুঝিয়ে দিয়েছিল কার্যকারণ। পরে নাম সংক্ষেপ করে 'ঠোঁটকাটা দাদু' -- হয়ে যায় 'ঠোকাদাদু'। সোজাকথার মানুষ। আমার বেশ লাগে। অপ্রিয় কথা সরাসরি বলেন। পাড়ার শাশুড়িদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে পাড়ার গিন্নি-বৌদি- ভ্রাতৃবধূদের গোপন মধুভাষ্যে ওলাউঠা, বীরডেঙো, মুখপোড়া ইত্যাদি বহু মূল্যবান বিশেষণ তিনি অর্জন করেছেন। আবার বুড়ো বজ্জাত, তোর খাই না পরি, আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে যা খুশি করবো তাতে তোর কী ! আড়ালে বলায় পাড়ার বৌমা-দের জুড়ি মেলে না।

তাকে দেখলে সবাই দূরে লুকিয়ে যায় মানে অ্যাডজাস্টমেন্টের সমস্যা বুঝে দাদু একদিন গ্রামের প্রান্তে পৈতৃক বাগানবাড়িতে ঘরবদল করে নিলেন। তিনি বোঝেন তাঁর তীক্ষ্ণধার জিভ সামলে রাখা অসম্ভব। এই নির্বাসনই ভালো।  সঙ্গী চিরপুরাতন হারাধন, বাগান-পুকুর- মায় ফুল বডি-মাইন্ড দাদুর কেয়ারটেকার। বুড়ো বাঘের মতো দাদুর চোখ ধারালো। সকাল ও বিকেলের হাঁটাপার্টিরা তাঁকে রীতিমতো সমীহ করে। সেদিন পাড়ার নাতি গবার বৌ সিমি বান্ধবীদের নিয়ে বায়ুকেলি করতে করতে যাচ্ছিল, দাদু বলে বসেন, তোমার গায়ে তো চর্বি নাই, মাংসও না, তাহলে হাঁটার কারণ কী? আর এত সাজগোজ দেখে মনে হয় ফ্যাশন শো করতে যাচ্ছো ! 

নাতবৌটি আধুনিকা ও সুরসিকা, সহাস্যে উত্তর দেয়, একেবারে ঠিক বলেছো দাদু। কেবল একটা হিরো
পাচ্ছি না। তোমার নাতি গবার চেয়ে তুমি ঢের বেশি হ্যান্ডসাম, আসবে নাকি ? 

দাদু হাঁ !  মনে মনে ভাবেন, বেশ রসিকা তো ! আমি শুনেই বলি, ও হলো -- কাঁটাবৌদি, কাউকেই কাঁটা মারতে ছাড়ে না।

গতকাল কোর্টের অর্ডারে যাদের চাকরি গ্যাছে তার মধ্যে আছে গোবিন্দ, তাদের এক বিঘে জমি বিক্রির তেরো লাখ টাকায় তার চাকরি। মনের দুঃখ ভোলার জন্য গোবিন্দ বন্ধু মুক্তিকে নিয়ে যাচ্ছিল দুটো দুঃখের কথা বলবে বলে। দাদুকে দেখেই ইউ-টার্ন নিয়ে ভ্যানিশ। বাঘ কিন্তু ঠিকই দেখেছে, শিকার ফসকে গেছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ওরে হারা, গোবিন্দর বাপের জমিবিক্রির টাকা গ্যাছে, কিন্তু বনমালী ? সে যে গরীবের ছেলে, কত কষ্ট করে নিজের যোগ্যতায় চাকরিটা পেয়েছিল, তার কী হবে ?

ছিঃ ! ছিঃ! হিরে আর কাঁকর একই দাম করে দিল রে ! 

তার যত দুঃখের কথা শোনে হারা মানে হারাধন তার পিএ কাম সেক্রেটারি কাম কুক কাম গার্ড কাম নার্স। এখন মেল নার্সের ডিমান্ড খুব, জানে না দাদু বা তার হারা। তারা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। হারা বলে, দাদু, এত চিন্তা করো না তো ! কাদের জন্য চিন্তা করো ? ওরা তোমার কেউ না। তুমি একটু ঠাকুরনাম করতে পারো তো? 

-- না রে হারা, ওসবে আমার বিশ্বাস নাই, আমার কাছে মানুষই ঈশ্বর। চাপড়ার মাঠের ছ বিঘে জমি দিয়েছি স্কুলের জন্য। স্কুল হয়েছে, মাস্টার নাই ছেলেমেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ কী ? হেলথ সেন্টারের জন্য দিলুম বারো কাঠা, একটা ঘর হলো বটে, না ওষুধ না ডাক্তার। মানুষের কত অসুবিধা বলতো? সব শুনি আর ভাবি, এমন দরদি ও অপ্রিয়ভাষী মানুষ যদি দাতা না হয়ে নিয়ন্ত্রক হতেন, অনেক কাজের কাজ করতে পারতেন।

সকালে বাঁকুড়া যাচ্ছি, শর্টরুটে যাবার সময় দাদুর সঙ্গে একবার দেখা করে যাবো - ভেবে বাগানবাড়ির দিকে  তাকাতেই দেখি, একটা জটলা আর গুঞ্জন, কেউ যেন কাঁদছে। বুকে একটা শিহরন লাগলো, ঠোকাদাদু ঠিক আছে তো? গিয়ে দেখি, হারাধনদা কাঁদছে, হাতে একটা খাম, আর সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে সবাই, বিমলদা বলে, তোকে একটা চিঠি দিয়ে গ্যাছে দাদু, পড়ে দ্যাখ।

ঠোকাদাদুর কথাগুলোও বেশ কাটা কাটা। কয়েকদিনের জন্য চললাম ভাই জয়, দেখি, দেশের কোথায় কী অবস্থা। খুব যন্ত্রণায় ছিলুম, কিছুটা বিলিয়ে আসি। হারাকে দেখিস। ভাবিস না, আমাকে কেউ রাখবে না, ঠিক ফিরে আসবো। মন বেশ ভারী হয়ে গেল।

প্রায় একমাস হয়ে গ্যাছে ঠোকাদাদু বাগানবাড়ি ছেড়ে গ্যাছে, কোনো খবর নাই। বিকেলে হোয়াটস অ্যাপে ভ্রামণিক বন্ধু বিজনের পাঠানো মেসেজ ও ছবি দেখে চমকে উঠি। তোর এক দাদুর ছবি ফেবুতে দিয়েছিলি না, স্কুল উদবোধনের ছবি, সেই জমিদাতা, ঠিক তেমনই দেখতে এক দাদুকে দেখলাম মন্দাকিনী হোটেলের থার্ড ফ্লোরে আমাদের রুম, চেক ইন করছি, তারপর তোর ঠ্যাকাদাদুর মতো দাদুটার সঙ্গে দেখা করবো। দেখেই ছবিটা রানিংয়ে তুলেছি, কেমন মিল দ্যাখ।

আমি কি-বোর্ড চালাই ... মতো নয় রে ভাই, ওই তো আমার ঠোকাদাদু, মনের দুঃখে ... 

আমরা হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছি রে, হৃষিকেশ- লছমনঝুলাটা আগে সেরে ফেলতে বললো, জগাদা। ওখানেই গুহাবাসের অভিজ্ঞতা নেবো। পরশু ফিরছি। তারপর তোর ঠ্যাকা না ঠকাদাদু যেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবো।

প্রবল হতাশায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম, দাদুকে পেয়েও হারিয়ে ফেললুম ? বিজনের উপর খুব রাগ ও বিরক্তি জন্মালো। ফেরার পর যদি দাদুকে আর দেখতে না পায় ?  তাহলে কী হবে ! কীভাবে আমি দাদুর সঙ্গে যোগাযোগ করবো ? মন উতলা হয়ে ওঠে আমার।
  
সেদিন রাত্রে খেতে বসে খেতে ইচ্ছা করলো না। বিছানায় শুয়েও ছটফট করছিলুম, ঘুম আর আসে না। শুধু মনে দাদুর মুখটা ভেসে উঠছে। আচ্ছা, তিনি কি আর ফিরে আসতে পারবেন ? সেটা কি সম্ভব ? আমারও তো ওসব জায়গায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা নাই, কিছুই চিনি না। ঘুম বা তন্দ্রাভাব এসেছিলো কি-না কে জানে ? মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো আর বাজতেই থাকলো। বিরক্তির সঙ্গে হাত বাড়িয়ে ধরলাম এবং মুহূর্তের হিসেবে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা প্রবল গরম স্রোত যেন নেমে গেল। সে প্রান্তে এক এবং অদ্বিতীয় আমার ঠোকাদাদু জোরালো গলায় বলছেন, কী রে ভাই, কেমন চমক দিলুম বলতো ? চিন্তা করিস না, এখানে তোরই মতো একজন নাতি পেয়ে গেছি। ওর নাম বিজয়, খুব ভালো ছেলে। আমাকে খুব যত্ন করছে ... 





জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। প্রধানত কবি ও গল্পকার। লিখেছেন অজস্র গল্প,কবিতা,গদ্য,প্রবন্ধ,গান ও নাটক। যেগুলি দেশ,কবিতা পাক্ষিক,কবি সম্মেলন,কলেজ স্ট্রিট, একুশ শতক সহ অজস্র নামি ও অনামি পত্রিকায় প্রকাশিত। প্রকাশিত গ্রন্থ : কাব্যগ্রন্থ : অভীষ্ট শব্দের উজানে এবং ত্রিভুজ সংক্রান্ত সমীকরণ। অণুগল্প গ্রন্থ : অণু অম্বুবান। সম্পাদিত পত্রিকা : তন্বী,দোলা ও স্বচ্ছন্দ। সম্মাননা ও পুরস্কার : পেয়েছেন অনামী,সোপান,ভোরাই,অণুপত্রী,আলোর জোয়ার,আবৃত্তিলোক,জঙ্গল মহল অনন্য কবি সম্মান,আবৃত্তিলোক সম্মাননা সহ অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা।