একটা নেতানো পৃষ্ঠা ~ মাসুদুল হক

 



আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। স্টেশনটা এখন একেবারেই ফাঁকা—কোনো গাড়ি নেই, কোনো আওয়াজ নেই, শুধু একটা চাপা নীরবতা। চারপাশে জীর্ণ টিনের ঘর, ভাঙা বৈদ্যুতিক খুঁটি, পেছনের জঞ্জালের স্তূপে আগুন জ্বালাচ্ছে দুটো বাচ্চা। তাদের চোখে আমি কিছু দেখি না—শুধু একটা শূন্যতা, যা একসময় আমার নিজের চোখেও ছিল।


আমি জানি না ঠিক কী খুঁজছি, তবে এটা জানি, আজ রাত নামার আগেই আমাকে পৌঁছাতে হবে। এই যাত্রার শুরু সেই চিঠিটা পাওয়ার পর—একটা পুরোনো বাইয়ের পাতার মধ্যে লুকানো, অদ্ভুত অক্ষরে লেখা: "ফিরে এসো, শেষটা এখনো লেখা হয়নি।"


আমার মনে পড়ে, সেই ঘরটার কথা—অর্ধেক ভাঙা, দরজাটা খোলা, ভেতরে একটা ভেজা গদি, যেন একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঘরটায় গুমোট একটা গন্ধ, সেই স্যাঁতসেঁতে দেয়াল, মাথা ঘোরা, পেটের মোচড়—যেন অতীতের কোনো স্মৃতি আবার শরীরে ফিরে এসেছে। ঘুম ভেঙে গেলে বুঝলাম, এটা শুধু স্বপ্ন ছিল না।


আমার চলার পথটা স্পষ্ট নয়। আমি মানুষের কাছে রাস্তা জিজ্ঞেস করি, তারা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাতেও চায় না। একটা সেতু পেরিয়ে আমি ঘুরে ঘুরে সেই একই জায়গায় ফিরে আসি। জলধ্বনি ভেসে আসে কানে—নদী কোথাও আছে, লুকিয়ে।


ঠিক তখনই তাকে দেখি। সে, যার মুখ ঝাপসা—তবু চোখ দুটো আমি চিনতে পারি।


—"তুমি এখানে কেন? বসো আমার পাশে।"


তার গলা নরম, অথচ রক্তহীন। আমি যদি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, হয়তো বুঝতে পারতাম, সে কি বলেছিল। কিন্তু আমার ভেতর এক বিপন্ন বিস্ময়!


তাকে নামিয়ে রাখা হয়—একটা ঘণ্টা বাজে, তারপর নিস্তব্ধতা। সে যেন কারো শেষ কথা বলে ফেলে, আমি শুনি না, বুঝি না। তার চোখ থেকে আলো সরে যেতে থাকে, আর আমার বুকের ভেতর একটা ভার জমে ওঠে।


আমি বুঝতে পারি, আমি একা ফিরছি না। আমার ভেতর এখন বহন করছি তাকে, আর তার মতো আরও কিছু নামহীন মানুষকে। তাদের নাম আর ছবি—সব ঝাপসা, অথচ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।


ভোর হয়ে আসে। ফেরার পথে, সমতলে, বাতাসে একটা উষ্ণ নিঃশ্বাস লেগে থাকে—হয়তো সত্যিই কোনো শেষ নিঃশ্বাস। নদী পিছনে পড়ে থাকে, একটা শহর তার মতোই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে!


আমি একটা প্রাচীন টেবিলে বসি। ওখানে রাখা কয়েকটি পালক, পুরনোটা ব‌ইটা এখনো সেখানেই।পাতা ওল্টাই, দেখি অচেনা হস্তাক্ষর—কিন্তু ভাষাটা আমারই।

একটা নেতানো পৃষ্ঠা, এক টুকরো ফাঁকা জমি—

সেখানেই আমি লিখি, কারণ আমার শরীর, আমার স্মৃতি, এখন একটা গল্পের অংশ— যা শুরু হয়েছিল এক শীতল স্টেশন থেকে আর শেষ হবে সেই প্রশ্নে:
"কে আমি, আর কেন আমাকে ডাকা হয়েছিল?"



মাসুদুল হক (১৯৬৮) কবি, কথাসাহিত্যিক,গবেষক ও অনুবাদক। আন্তর্জাতিক ব্লগ ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত ইংরেজি কবিতা লেখার পাশাপাশি অনুবাদ করে চলেছেন।আদিবাসী জীবন ও লোকসংস্কৃতি তার আগ্রহ ও গবেষণার অন্যতম বিষয়। বাংলা একাডেমির রিসার্স-ফেলো (১৯৯৭-২০০০) হিসাবে ড. হায়াৎ মামুদের তত্ত্বাবধানে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে । অভিসন্দর্ভ : নন্দনতত্ত্ব : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশের কবিতা (১৯৪৭-১৯৯০)। পেশায় সরকারি কলেজে দর্শনের অধ্যাপক। বর্তমানে অধ্যক্ষ, বীরগঞ্জ সরকারি ডিগ্রি কলেজ, দিনাজপুর। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশ। তার উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ "তামাকবাড়ি"; গবেষণাগ্রন্থ " বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব ", "টি. এসে. এলিয়ট ও অন্যান্য", " বাংলা সাহিত্যে নারী" প্রভৃতি।২০২০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা THE POET কর্তৃক "International poet of week” ভূষিত হয়েছেন ।আন্তর্জাতিক কবিতায় অবদানের জন্য পর্তুগাল থেকে স্বীকৃতি স্বরূপ অর্জন করেছেন গোল্ডেন শিল্ড সম্মাননা (২০২১); এছাড়াও গদ্যসাহিত্যে বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার(২০১১);কথাসাহিত্যে  চিহ্ন পুরস্কার(২০১৩),রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; লোকসাহিত্যে দিনাজপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার (২০১৪) অর্জন করেছেন । অনুবাদের জন্য চর্যাপদ পুরস্কারে (২০২৩) ভূষিত হয়েছেন।প্রবন্ধ-গবেষণায় পেয়েছেন রংপুর সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ পদক(২০২৪) এবং মহীয়সী সম্মাননা (২০২৫)।