এক মুঠো রোদ্দুর ~ মৌসুমী ঘোষ দাস

 


আজ পাঁচ দিন ধরে ফুলমনির ধুম জ্বর। বিছানায় প্রায় শয্যাশায়ী। বুধনবাটি গ্রামের ফুলমনি টুডু রামা টুডুর বিধবা বউ। রামা টুডু ওই এলাকায় সম্পন্ন কৃষক ছিলেন। পাঁচ বছর আগে মাত্র তিন দিনের জ্বরে রামা টুডুর মৃত্যু হয়। অবশ্য সময়মত জানগুরুর জল পড়া মুখে দিলে স্বামীটাকে হয়তো বাঁচানো যেত। কিন্তু অসুস্থ স্বামীকে একা ফেলে জানগুরুর কাছে সেদিন যেতে পারেনি বলে ফুল মনি আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনা। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে গ্রামের বাড়িতে ফুলমনি একাই থাকে। ফুলমনি বড় অসহায়। নিজের বলতে তিন কূলে এমন কেউ নেই যে ওর পাশে এসে দাঁড়াবে। ওর একমাত্র জীবিত সন্তান সোনামণির বিয়ে হয়েছিল রংডুলা চা বাগানে। জামাই চা বাগানেই কাজ করে। দুই বছর আগে বাচ্চা হতে গিয়ে ওর মেয়েটা মারা যায়। বাচ্চাটা নাকি উল্টো বেড়িয়েছিল। ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মেয়েটা বোধহয় বাঁচত। কিন্তু হাসপাতাল চা বাগানের বস্তি থেকে দশ কিমি দূরে। যাতায়াত ব্যবস্থাও ভাল নেই। তাই বাড়িতেই মহিলারা টানাটানি করে চেষ্টা করেছিল বাচ্চা প্রসবের। ফলস্বরূপ মা-বাচ্চা দুজনারই মৃত্যু ঘটে। তারপর থেকে জামাইয়ের সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখে না ফুলমনি।

বেঁচে থাকতেই রামা টুডু চাষবাস করে মাটির দোতলা বাড়ি করেছিল , বাড়িতে কুয়ো বসিয়েছিল । বাড়ির চারিদিকে কিছু গাছ গাছালিও লাগিয়েছিল। আসলে মাটিটা এত ভাল যে সামান্য পরিচর্যাতেই গাছগুলো সারাবছর ফল ভারে নুয়ে থাকে। আর তা নিয়েই প্রায় প্রতিদিন অশান্তিও লেগেই রয়েছে। কারন, গ্রামের ছেলেপিলেগুলোর নজর ফুলমনির বাগানের আম, লিচু, পেয়ারা, কুলের দিকে। সুযোগ পেলেই গাছে উঠে চুরি করে। যখন তখন গাছে ঢিল পরে। একাকী ফুলমনি দাঁত কিটমিট করা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না, হাতে নাতেও ধরতে পারে না। ওই ছেলেগুলোর সর্দার পাশের বাড়ির হারানু কিস্কুর ছেলে পালানু । হারানু আবার এই গ্রামের মাতব্বরদের একজন। এই পালানুকে ফুলমনি দু চক্ষে দেখতে পারে না। একবার হয়েছিল কি, কুয়োর পারে বসে বাসন মাজছিল ফুলমনি। হঠাৎ পালানুর হাতের ঢিল এসে পড়ল সরাসরি ফুলমনির মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল মাথা থেকে। টলমল পায়ে উঠে পাতার রস করে মাথায় লাগিয়ে কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখল। সেবার বেশ কদিন লেগেছিল ফুলমনির সুস্থ হতে । ছোট খাট অসুখ বিসুখে এই গ্রামের লোকেরা গাছের পাতা, বা শেকড় বাকড় দিয়ে নিজেরাই চিকিৎসা করে থাকে। নতুবা জানগুরুর মন্ত্রপূত জল কদিন খেলেই রোগ সেরে যায়। পারতপক্ষে হাসপাতাল যায় না বললেই চলে। আর যাবেই বা কি করে? হাসপাতাল যে আট কিলোমিটার দূরে। রাস্তার যা অবস্থা! হাসপাতাল যেতে যেতে অসুস্থ মানুষ আরও অসুস্থ হয়ে যায় !

তা ওই হাড়বজ্জাত পালানু যখন তখন ফুল মনির বাগানে নিজেদের ছাগলটাকে ঢুকিয়ে দেয়। কলমির ডাল পুঁতে বাড়ির সামনের জায়গাটা ঘিরে কিছু বেগুন চারা, টম্যাটো, লাল শাক লাগিয়েছে ফুলমনি। বেগুন পোড়া, বা টম্যাটো পোড়া অথবা লাল শাক দিয়ে দুটো ভাত তৃপ্তি করে খায় ফুলমনি। বেগুন গাছে কি সুন্দর ছোট ছোট বেগুনও ধরেছিল। ছাগলটাকে ঢুকিয়ে সব নষ্ট করে দেয় পালানু। তর্কাতর্কির সময় ফুল মনি শুধু বলেছিল, এরপর বাগানে ছাগল ঢোকালে ছাগলকে খোঁয়াড়ে দেবে। ব্যাস, অমনি সে কি গাল খিস্তি, মারার হুমকি। একে তো পালানুর বাবা হারানু গ্রামের মাতব্বর, তায় আবার ফুল মনি একা মেয়েমানুষ, তাই বেশি কিছু প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। এ ব্যপারে গ্রামের অন্য মাতব্বরদেরও নালিশ করতে ভয় পায়। স্বামী মারা যাবার পর থেকে দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা আর গ্রামের মাতব্বরগুলো নানা বাহানায় ফুলমনির দোষ খুঁজে বেড়ায়। স্বামী ও মেয়ের মৃত্যুর জন্য ফুলমনিকে ডাইনি বলে সন্দেহ করে। ফুলমনি সব বোঝে, আসলে ওর বাড়ি, বিষয় আশয়ের প্রতি ওদের নজর।

আজ পাঁচ দিন ধরে ফুলমনির জ্বর। বিছানায় পরে আছে। কোন খাবার মুখে দেয়নি। আর কেই বা দেবে ওকে মুখের কাছে খাবার এগিয়ে? জ্বরের ঘোরে খিদেও তেমন বুঝতে পারছে না। মাতব্বরদের চোখ রাঙ্গানির ভয়ে আসে পাশের বাড়ি গুলোর সাথে তেমন কোনও ভাল সম্পর্ক রাখতে পারে না। সে বার মাথা ফেটেছিল পাশের বাড়ির পালানুর ঢিলে। আর তারপর থেকে ও বাড়ির বড়দের সাথেও মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ। তাই বলে পালানুর অত্যাচার থামেনি। আজও একবার এসে কুল গাছ থেকে কুল পেরে নিয়ে গেছে। সারা উঠান গাছের পাতা, কচি ডালপালা ফেলে নোংরা করে গেছে। আর জন্মে ওর সাথে কি শত্রুতা যে ছিল কে জানে। ঘরের ভেতর থেকে শয্যাশায়ী ফুলমনি সবই বুঝেছে, দাঁত কিটমিট করে অভিশাপ দিয়েছে। ব্যস ওই পর্যন্তই।

খুব জল তেষ্টা পেয়েছে ফুলমনির। দুর্বল পায়ে আস্তে আস্তে হেঁটে কুয়োর ধারে এসে দাঁড়ালো। দড়ি বাঁধা বালতিটা ধীরে ধীরে নামাল কুয়োতে আর অল্প একটু জল ভরে বালতিটা কুয়োর বাইরে তুলে আনল। তারপর ঘটি করে জল নিয়ে দাওয়ায় বসে তেষ্টা মেটাল। মাথাটা ঘুরছে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। আজ জ্বরটা একটু কম আছে তাই বুঝি খিদে খিদেও পাচ্ছে। পাঁচ দিন হল দুটো ভাত পর্যন্ত খেতে পায় নি সে। আর এখন ওর শরীরের যা অবস্থা ভাত রান্না করার শক্তিও নেই শরীরে। মনে পড়ল, রান্নাঘরে কৌটায় মুড়ি আছে অল্প। একটু মুড়ি মুখে দেবে বলে উঠে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই অজ্ঞান হয়ে উঠানেই পড়ে গেল ফুলমনি। কতক্ষণ সেভাবে পড়েছিল কে জানে! জ্ঞান ফিরতে দেখে ওর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ে শ্যামলী মারডি ফুলমনির ঘরের উঠান থেকে ঊদ্ধশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে। যেন কিছু একটা দেখে খুব ভয় পেয়েছে।

আসলে ওই সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় শ্যামলী ফুলমনিকে মাটিতে পরে থাকতে দেখে এগিয়ে এসেছিল। আর তখনই ফুলমনির আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরে আসে, আর চোখের সামনে শ্যামলীকে দেখে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে, হয়তো বা মেয়েটাকে ধরে মাটি থেকে ওঠার চেষ্টা করে। বাচ্চা মেয়ে শ্যামলী, পাঁচ দিনের ধুম জ্বরে আক্রান্ত আলুথালু চুলের, লাল চোখের, রুক্ষ- শুষ্ক চেহারার ফুলমনিকে ওর দিকে হাত বাড়াতে দেখে ডাইনি ভেবে ভয়ে দৌড়ে পালায়। এমনিতে সামান্য দোষ ত্রুটিতেই পাড়ায় ফুলমনির ডাইনি অপবাদ ছিলই। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ও অশিক্ষিত শ্যামলী মা বাপের কাছে শুনেছে ডাইনিরা চোখ দিয়ে শরীরের রক্ত শুষে নেয় আর অসুখ দিয়ে মানুষ মারে। শ্যামলী ছুটতে ছুটতে বাড়ি গিয়ে ভয়ে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরলে পরে বড়দের সব কথা খুলে বলে। এক কান দু কান হয়ে সারা গ্রামে এই বার্তা রটে গেল। মাতব্বরদের কানেও গেল। আর তো দেরি করা যায়না! এবার তো একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে! এই ক বছর ধরে ফুল মনির সম্বন্ধে ওরা যা সন্দেহ করেছিল, শ্যামলীর কথায় যে তা সত্যি বলে প্রমানিত হল! ডাইনি না হলে অমন লাল লাল চোখ হবেই বা কেন, আর একা পেয়ে ওকে ধরতে চাইবেই বা কেন? আর শ্যামলী অজ্ঞানই বা হবে কেন?

সেদিন দুপুরে গ্রামের পুরুষ মহিলারা সব অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে ফুলমনির পাশের বাড়ি মাতব্বর হারানু কিস্কুর বাড়িতে জমায়েত হল। অস্ত্র শস্ত্র বলতে ঝাড়ু, লাঠি, কোদাল, শাবল, হাত দা প্রভৃতি। ঠিক হল আজ ওকে গ্রাম থেকে মেরে তাড়াতেই হবে, নয়তো ওর ব্যাপারে সারা জীবনের মত একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। কথা মত হারানুর বউ গিয়ে অসুস্থ দুর্বল ফুলমনির চুলের মুঠি ধরে টেনে বাইরে বের করে আনল। ফুলমনি উঠানে মুখ থুবড়ে পড়ল। তারপর ঝারু আর লাঠি দিয়ে সমবেত ভাবে মার শুরু হল। জ্বরে ভুগে পাঁচ দিন খাবার খেতে না পাওয়া দুর্বল ফুলমনি শীঘ্রই জ্ঞান হারাল।

জ্ঞান ফিরলে দেখে সে হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আছে। আস্তে আস্তে তার সব কথা মনে পরে গেল, কিন্তু কি করে সে হাসপাতাল অবধি এসে পৌছালো কিছুতেই সে ভেবে পেল না। বিছানায় শুয়ে ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখে ভবেন তিরকে ও দুই জন পুলিশ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ভবেনকে ফুলমনি চেনে। ওদের সম্প্রদায়ের ছেলে। কিন্তু শহরে থেকে লেখা পড়া শিখে চাকরি নিয়ে গ্রামে প্রাইমারী বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে। ও আবার গ্রামের উন্নতির জন্য খুব চেষ্টা করে। যে সব আদিবাসী গ্রাম অশিক্ষা, কুসংস্কার, অন্ধকারে পিছিয়ে আছে, সে সকল গ্রামে গিয়ে সমীক্ষা করে রিপোর্ট তৈরি করে ব্লক অফিসে জমা করে আসে। সরকারিভাবে গ্রামে গ্রামে পানীয় জল সরবরাহের জন্য চেষ্টা করে। গ্রামের বাচ্চাদের সাথে মেলামেশা করে ওদের স্কুলে যেতে আগ্রহী করে তোলে।
ভবেন এগিয়ে এসে ফুল মনিকে জিজ্ঞেস করল -এখন কেমন আছেন? ফুল মনি ভয়ে মাথা নেড়ে জানালো, ‘একটু ভাল, তবে শরীর বড় দুর্বল!

-আর চিন্তা করবেন না। খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন। আপনার পাশের বাড়ির পালানু এসে যদি আমায় সব কথা খুলে না বলতো, তবে তো আজ খুব বড় অঘটন ঘটে যেতো। পালানু যখন ঘরে বসে ভাত খাচ্ছিল, তখন গ্রামের সবাই ওদের বাড়ি এসে আপনাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছিল। সে কথা কানে যেতেই পালানু এক ছুটে এসে আমাকে সব বলে। আমি তখন থানা থেকে পুলিশ নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান আপনাকে রক্ষা করে হাসপাতালে ভর্তি করি।

-সুস্থ হলে আপনাকে একবার থানায় যেতে হবে। বেশ কয়েকজনকে আমরা গ্রেফতার করেছি। তাদের সনাক্ত করতে হবে। এখন সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে থাকুন। আমরা সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তাছাড়া দু বেলা এসে খোঁজ নিয়ে যাবো। -পুলিশ অফিসারটি বললেন।

ফুলমনি আর কথা বলতে পারল না। কান্নায় গলা বুজে এল। মাথা নেড়ে পুলিশ অফিসারের কথায় সম্মতি জানাল। মনে মনে ভাবল, যে পালানুকে ফুলমনি দু চক্ষে দেখতে পারত না, দিবারাত্র দাঁত কিটমিট করে অভিশাপ দিত, সেই পালানুই কেমন করে আজ অসহায় ফুলমনির স্বজন হয়ে গেল! পুলিশের কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত জেনে ভবেন ও ফুলমনির এতদিনের দু চক্ষের বিষ সেই পালানুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ফুলমনির ফ্যাকাসে শুকনো চোখে যেন বান এল। মনে হল, কোথা থেকে এক মুঠো রোদ্দুর এসে ফুলমনির মেঘলা ভুবন ভরিয়ে দিল।

মৌসুমী ঘোষ দাস