- খুব হয়, খুব হয়। বিকাশ একটা বিকট মুখ করে বলল, তোমাকে বিয়ে করলুম আর একটু সুখ দিতে পারব না? আমার প্রস্তাবটা তোমার অপছন্দ কিসে?
উত্তরটা মিনতির ঠোঁটের কাছে এসেও বেরোচ্ছিল না। কয়েকবার ঠোঁটটাই শুধু কাঁপল।
- বুঝেছি আমি দোজবরে বলে? তা একটা পয়সাও তো খরচা করতে হয় নি তোমার বাবাকে। বিকাশ বলল, নেহাত এতবড় একটা ছেলের ঝক্কি এই যা। আর সেই জন্যেই তো বলছি এই ঝঞ্ঝাট যাতে আর না থাকে। তোমার নিজের একটা ছেলে কি তুমি চাও না?
মিনতি শুধু কাঁদছিল। বিকাশ বলল, ও, তুমি ভয় পাচ্ছ? কিছু চিন্তার নেই মাই ডিয়ার। সব ব্যবস্থা আমিই করব, তুমি শুধু একটু পাশে থাকবে আমার এই যা।
সৌম্য ইস্কুল থেকে ফিরল। ধপাস করে ব্যাগটা টেবিলে ফেলেই মায়ের কোলে বসে পড়ল। মাকে এত ভালবাসে কে জানে? কিন্তু ভালবাসে সেটা সবাই জানে। মায়ের জন্যে কত গর্ব হয় সৌম্যর। ইস্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে বা খেলার মাঠ থেকে ফিরতে দেরি হলেই প্রবল দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে মায়ের মুখে। সেটা বাচ্চা ছেলে হলেও বেশ বুঝতে পারে সৌম্য। বন্ধুদের কাছে বুক ফুলিয়ে বলে মায়ের কথা। মা তাকে কত ভালবাসে।
- জানিস আমার মা আমার পৌঁছতে দেরি হলে শুধু বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকবে সারাক্ষণ। একদিন গিয়ে দেখি মাকে মশা একেবারে ছেঁকে ধরেছে। ফুলিয়ে দিয়েছে সারা পা।
বন্ধুর দল হো হো করে হেসে অস্থির।
- মা? মা কিরে? সে তো তোর সৎ মা?
সৎ মা কথাটার মানে জানে সৌম্য। কিন্তু জানে না কথাটা নিয়ে কিছু লোক কেন কানাকানি করে। অর্ক হল সৌম্যর প্রিয় বন্ধু। মাঝে মাঝে তার বাড়িতে যায় সৌম্য। ওর বাবা ওকে খুব ভালবাসে। অনেক গল্প করে, অনেক কথা হয়। একদিন বলল, তোর মা তোকে কেমন ভালবাসে রে?
সৌম্য মায়ের ভালবাসা দেখাতে হাত আকাশ সমান করে বলল, এই এত উঁচু।
অর্ক বলল, দূর বোকা। বাবা তোকে জিজ্ঞেস করছে তোর মা তোকে ঠিক নিজের মায়ের মত ভালবাসে কিনা।
কথাটা সৌম্য ঠিক বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। অর্কর বাবা জানাল সৌম্যর বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কথা, বাচ্চা ছেলে ছিলি তুই। এমন সময় তোর মা মারা গেল। কি করবে বেচারি বল? সারাটা জীবন তোকে এই সৎ মাকে নিয়ে ঘর করতে হবে।
বেশ কিছুক্ষন সৌম্যকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ পাড়ায় একটা সোরগোল উঠল। সৌম্যকে নাকি খুন করা হয়েছে। অমনি বাড়ির সামনে বেজায় ভীড়। গ্রীলে টং টং আওয়াজ আর দেওয়ালে আর দরজায় ধপধপ। মিনতির নামে ডাইনি, দজ্জাল, খুনি সব যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগাল। পাড়ার বেশ কিছু লোক বলছে। বলছে, সত্যিই তো সৎ মা আর কত ভাল হবে? নিজের একটা ছেলের জন্যে – ছি ছিঃ!
আর মিনতি শুধু কেঁদেই চলে। আজ তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বাঁচবার সব অবলম্বন যেন হারিয়ে ফেলেছে সে।
বিকাশ নিশ্চুপ। তার নীরবতা তার ওপর পড়শীদের সহানুভূতি আরও বাড়িয়ে দেয়। গেট খোলা পেলে মিনতিকে তো তারা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এটা তো চায় না বিকাশ। সে চায় নতূন একটা সংসার। একেবারে আনকোরা – পুরোনর কিছুমাত্র চিহ্ন থাকবে না সেখানে। মিনতি থাকবে সেখানে কিন্তু থাকবে বেশ চাপের মধ্যে।
তাই সে গেট আর মুখ কোনটাই খোলে নি।
এমন সময় থানার জীপ এসে থামল। নামলেন শিবেন দারোগা। পেছন পেছন কন্সটেবলের হাতে হাতকড়া পরান দুজন গুন্ডা মতন লোক।
- এই লোকটাই স্যর আমাদের টাকা দিয়ে লাগিয়েছে। আমরা তো নিজে থেকে কিছু করতে যাই নি। একে পেয়েছেন এবার একে ধরুন। আমাদের ছেড়ে দিন।
বলে বিকাশকে দেখাল তারা।
পাড়ার লোকেরা তো বিশ্বাসই করে না। বিকাশের মত ভাল লোক। যত নষ্টের গোড়া ঐ মেয়েটাই স্যর। খুন যদি করাতেই হয় তো ঐ ডাইনিটা করিয়েছে দুধের শিশুটাকে।
- কে ডাইনি? শিবেন দারোগা বললেন ব্যঙ্গের স্বরে, যে মেয়েটা তার সৎ ছেলেটাকে খুনের হাত থেকে বাঁচাল সে ডাইনি? এটা গ্রাম নয় শহর। আপনাদের এমন বুদ্ধির বহরের জন্যেই তো গ্রামের মেয়েরা ডাইনি হচ্ছে আজও। এই একবিংশ শতকেও।
দারোগার ইঙ্গিতে এরপর জীপের ভেতর থেকে বেরোল জীবিত সৌম্য। আর ঝুলি থেকে বেরোল কালো কুচকুচে কিছু বেড়ালও। জানা গেল মিনতিকে বিয়ে করেছিল বিকাশ সৌম্যকে মানুষ করার জন্যে এটা ঠিক। কিন্তু প্রেম-পীরিতের বহরটা বেশী বইল নতূন বৌয়ের খাতে। মিনতি নিজের ছেলে মানে নিজের পেটের ছেলে হোক কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বড় হয়ে দুই সৎ ভাই কি সৎ ভাইবোন কি করবে তা ঠিক নেই। সৌম্যকে যে সে খুব ভালবেসে ফেলেছে।
অতএব বিকাশ কর্তৃক সৌম্যকে চিরতরে সরিয়ে ফেলার প্ল্যান। বিকাশ জানে মিনতি তাকে এ কাজে সমর্থন বা সহায়তা কিছুই করবে না। তাই ভালভাবে সতর্ক করেছিল, ফাঁস করলে তোর গলাটা নামিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব। ভাবিস নি বৌয়ের আমার অভাব হবে না।
- মিনতিদেবী সময় মত থানায় গিয়ে এই চক্রান্তের কথা না জানালে রক্ষা পেত এই বাচ্চাটা? দারোগা বলে চললেন, আর আপনারা কিছু না জেনেই তাকে ডাইনি ডাইনি বলছেন লজ্জা করছে না।
তা এতক্ষনে একটু লজ্জা করছে বইকি জনতার। যত যাই হোক অমানুষ তো আর সবাই হয়ে যায় নি। একজন নেতা মত বলল, আমরা সত্যি লজ্জিত দারগাবাবু। আমাদের বুদ্ধির দোষে গ্রামে গঞ্জে এমনভাবে কত মেয়ের সর্বনাশ হচ্ছে কে জানে। কিন্তু এই বিকাশ নামের শয়তানটাকে ছাড়বেন না। ওকে ফাঁসি দিন। নিজের ছেলেকে খুন করতে চেয়েছিল ছি ছিঃ।
সম্মিলিত জনতা প্রতিধ্বনি তুলল, হ্যাঁ হ্যাঁ বিকাশের ফাঁসি চাই।
সৌম্যকে মিনতির কাছে দিয়ে গেলেন দারোগা। বললেন, সত্যিই মা আপনি ওর। সৎ মা মানে ইংরেজিতে যাকে বলে অনেস্ট মাদার। আপনার হাতেই ও যথার্থ মানুষের মত মানুষ হবে।
সৌম্যকে বুকে চেপে একটানা কাঁদছিল মিনতি। অবাক হয়ে সৌম্য বলল, তুমি কাঁদছ কেন মা? আমার কি হয়েছিল মা? বাবাকে ওরা কোথায় নিয়ে গেল মা?
- সে কথা শুনে কাজ নেই বাবা। সেকথা শুনতে নেই। মিনতি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। শুধু সৌম্যর জন্যেই নয় তার বাবার জন্যেও। হাজার হলেও স্বামী তো বটে।