বুমেরাং ~ মৌসুমী ঘোষ দাস

    


একা ফিরছিলাম সাজাহানপুর থেকে। গাড়িতে খুব ভিড় ছিল সেদিন। একে তো ছোট গাড়ি, তা তে আবার মুখোমুখি তিনজনের সিটে ঠেসেঠুসে চারজন করে যাত্রী নিয়েছে। পেছনে পাদানিতে লোক ঝুলছে। তার ওপর গাড়ির ছাদে প্রচুর মাল তুলেছে বলে স্পীডও নিতে পারছে না তেমন। প্রায় গরুর গাড়ির মত চলছে গাড়িটা। সেদিন আবার তাপমাত্রার পারদ ৪১ ডিগ্রি ছুঁয়েছে। আমার এমনিতে গরম আর ঘাম খুব বেশি। বাইরে গরম বাতাস বইছে। তার হলকা আসছে ভেতরে। গাড়ির ভেতর এতগুলো মানুষের গাদাগাদি অবস্থান সঙ্গে ঘামের দুর্গন্ধ ! আমিও গলগল করে ঘামছিলাম। শুধু গাড়িটা যখন ফাঁকা জায়গা দিয়ে চলছিল, তখন অবশ্য একটু হাওয়া পাওয়া যাচ্ছিল।

কিছু আগে একটা ছোট জ্যাম পেরিয়ে যখন গাড়িটা একটা ছায়াঘেরা আমবাগানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তখন বেশ সুন্দর একটা হাওয়ায় শরীরের ঘাম শুকিয়ে গেল।। আমের মুকুলের গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। আঃ! কি মিষ্টি হাওয়াটা! সেই মিষ্টি হাওয়া আর সাথে গাড়ির দুলুনিতে বেশ একটা ঘুম ঘুম ভাব আসছে। চোখটা একটু আধ বোজা অবস্থায় রেখেছি। মাঝে মাঝে চোখ সামান্য খুলে দেখছি কতদূর এলাম। এরকমই একবার চোখটা একটু খুলেছি তো দেখি আমাদের গাড়ির ওপর থেকে কি একটা যেন ঝুরির মতো আছড়ে নিচে পড়ে, গড়াতে গড়াতে রাস্তার ধারে খাদের দিকে চলে গেল। মনে হল, আমি ছাড়া কেউ তেমন খেয়ালও করল না বিষয়টা!

বিরক্তি লাগে এসব বোধবুদ্ধিহীন মানুষদের জন্য। আরে বাবা! গাড়ির মাথায় মাল নিবি ভাল কথা, তা মালটাকে তো ভাল করে বাঁধবি রে বাবা! রাস্তার যা অবস্থা! কেবল ঝাঁকুনি আর ঝাঁকুনি! ঠিক করে না বাঁধলে তো মাল পড়বেই। আবার ভেতরের দরদী মনটা ভাবল, “আহা! কার যে কি পড়ল, কতটাই বা ক্ষতি হল কে জানে? একবার চিৎকার করে বলা উচিত নয় কি, ‘ওগো, গাড়ির মাথা থেকে কার কি পড়ে গেল গো! তাহলে গাড়ি থামিয়ে নিশ্চয় খোঁজ করলে জিনিসটি পাওয়া যাবে।”

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাইরের মনটা তিতি বিরক্ত হয়ে বলল, খুব বেশি হয়তো ক্ষতি হবে না, একটা ঝুরিই তো পড়েছে মাত্র। কতই বা দাম তার? যাক গে, এটুকু শিক্ষা হওয়ার দরকার আছে বোধ বুদ্ধিহীন মানুষটার । কেউ, এমনকি যার মাল সেও যখন খেয়াল করেনি, আমার খেয়াল রেখে বলতে বয়েই গেছে। সারাটা পথ চোখ বুজে ঘুমের ভান করে চলে এলাম। যখন গন্তব্যে পৌঁছুলাম তখন দেখি একজন লুঙ্গি পরা বয়স্ক মানুষ তার তিনটি ঝুরির মধ্যে একটি নেই বলে কাঁদোকাঁদো হয়ে চিৎকার শুরু করল। গরীব মানুষ তার মেয়ের বিয়ের জন্য হাট থেকে কিছু আনাজ পাতির সাথে ঝুরিটি কিনে ফিরছিলেন। সেই ঝুরিটিই পরে গেছে। লোকটি ড্রাইভারের সাথে খুব ঝগড়া করতে লাগল। আমি যথারীতি ভাড়া চুকিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।

এই ঘটনার তিন বছর পর ট্রেনে ভাগলপুর থেকে ফিরছিলাম। সেবারও আমি একা ছিলাম। ট্রেনটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল।আমি হকারদের থেকে কিছু খাবার কিনলাম। তারপর আমার উল্টোদিকের আসনে এক বৃদ্ধ দম্পতি ছিলেন, ওদের আমার ব্যাগটার দিকে নজর রাখতে বলে বাথরুম গেলাম। বাথরুম যাবার জন্য পা বাড়িয়েছি আর অমনি ট্রেনটা চলতে শুরু করল। তখুনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ময়লা জামাকাপড় পড়া একটা অল্প বয়সী ছেলে আমার হাত থেকে নতুন কুড়ি হাজার টাকায় কেনা মোবাইলটা ছোঁ মেরে নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে এক ছুটে প্লাটফর্মের বাইরে পালিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের গতিও ভীষণ বেড়ে গেল। প্রানের চেয়েও প্রিয় সেই নতুন মোবাইলটার জন্য আমি কিছু করতে না পেরে শুধু আর্তনাদ করে গেলাম। পরের স্টেশনে নেমে অবশ্য রেল পুলিশে চুরির অভিযোগ জানিয়েছিলাম। কিন্তু মোবাইল ফিরে পাইনি। তখন শুধু তিন বছর আগের সেই মেয়ের বিয়ের ঝুরি হারানো অসহায় হত দরিদ্র মানুষটির কথা মনে হতে লাগল। সেদিন আমার কাছে সেই ঝুরির দাম নগন্য হলেও অসহায় দরিদ্র মানুষটির কাছে কিন্তু তার দাম অমূল্য ছিল। আমি তার ঝুরি পরে যেতে দেখেও চোখ বুজে ছিলাম। তাই আজ আমার কাছে অমূল্য ধন মোবাইলটা চুরি যেতে ওপরওয়ালাও চোখ বুজে থেকে আমায় চরম শিক্ষা দিলেন।


মৌসুমী ঘোষ দাস ,