আতঙ্কের কয়েকটি মুহূর্ত ~ আজিজুল হাকিম




২৫শে অক্টোবর ২০১৩। হেমন্তের পরিষ্কার আকাশ। ২৯ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। ঝক ঝকে নতুন বোইং 737-700 বিমান রৌদ্রজ্জ্বল দুপুর বেলায় 'সুবর্ণভুমি' বিমানবন্দর থেকে পশ্চিমে পেখম মেললো অভিজ্ঞ বর্ষীয়ান আমেরিকান [বা ক্যানাডিয়ান] পাইলট এর নেতৃত্বে। 'ঢাকা' যেহেতু পরবর্তী গন্তব্য,যাত্রী প্রায় সবই বাংলাদেশী। বিদেশ ভ্রমন শেষে স্বপরিবারে ফিরার আনন্দে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে হৈ হল্লা করে একটি উৎসব মুখর সময় পার করছিল সবাই। এর মাঝে ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলেনঃ আমাদের সামনের আকাশ পথে কিছুটা 'টারবুলেন্ট এরিয়া' আছে। সামান্য ঝাকি পরিলক্ষিত হতে পারে, তাই সিট বেল্ট বেঁধে রাখার অনুরোধ। কেউ বিশেষ পাত্তাই দিলনা। হাঁটা-হাটি, 'এই তোর নতুন ক্যামেরাটা দিয়ে একটা ছবি তোল' এসব নিয়ে যাত্রীরা মহা ব্যাস্ত। কেবিন ক্রুরা লাঞ্চ সার্ভ করছে, আবার ক্যাপ্টেনের ঘোষণা এলো সিট বেল্ট বেঁধে রাখার জন্যে। তবে ভয়ের কোন কারন নেই, নতুন প্রজন্মের বিমানে সমস্যা সংকুল এলাকা সনাক্তকরণ যন্ত্র সজ্জিত বলে, আগে থেকেই সাবধান হওয়ার ব্যবস্থা আছে। হয়তো সামান্য ঘুরা পথে যেতে গন্তব্য পৌছতে সময় একটু বেশী লাগতে পারে। এর মাঝে বেশ কয়েকবার মৃদু ঝাকনি লক্ষ করা গেলেও, যাত্রীদের হৈ-চৈ এক মুহূর্তের জন্য থামেনি। ক্যাপ্টেন আবার 'বিল্ড ইন স্পিকারে' খোশ গল্প আকারে বলে চলছে, আমরা এই মুহূর্তে 'বার্মা এয়ার স্পেসে' প্রবেশ করলাম। নিচের এলাকা গুলি আনেকে 'গোল্ডেন ট্রায়এঙ্গেল' বলতে পছন্দ করে, আমাদের গ্রাউন্ড স্পীড 0.785 Mach, যা ত্রিশ হাজার ফিট উচ্চতায় আনুমানিক ঘণ্টায় ৮৫৮ কিলোমিটার। সুস্বাদু খাবার আর বাচ্চা-কাচ্চাদের চেঁচামেচিতে বাকি সব কথা বুঝাই গেলনা। মাঝখানের আমি, জানালার ধারে আমার স্ত্রী ও আইলস্ সীটে আমার ছেলে।প্লেনের মধ্যভাগে একেবারে ডানার সাথে আমাদের সীট। সামনে আর পিছন দুই ধার থেকে খানা পরিবেশন করতে করতে কেবল বিমান বালারা আমাদের কাছে এসছে। খাবার ট্রে দেয়া শেষে। জুস, কোমল পানীয় পরিবেশন করছে। কোন রকম পূর্বাভাষ ছাড়াই হঠাৎ মনে হল, আমরা যেন ছুঁড়ে দেয়া "টেনিস বল" ! মাটিতে পরে যেভাবে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ছুটে চলে, সেরকম প্রচণ্ড গতিতে নিচের দিকে ছুটে চলছি।

সেকেন্ডের মধ্যে চিৎকার, 'ইয়াহ আল্লাহ', 'লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবাহা নাকা ইন্নি কুন্তুম মীনাজ জোয়ালইমিন', 'ও ভগবান' জপা শুরু হোল, কেউ একজন আবার আজান দিচ্ছে, কান্নাকাটি চেঁচামেচি সব এক সাথে! আমাদের সামনে বসা আমেরিকান তরুণী ' ও গড, ও গড ' বলে কি যেন বির বির করছে। আমার স্ত্রীর রিয়েকশান হথভম্ভ, নির্বাক হয়ে বসে আছে। বেচারা কেবলই খাবার এর ফয়েল পেপারের ঢাকনা খুলে এক-আধ চামচ মুখে পুরেছে। বিমানবালার সফট ড্রীঙ্কসের ট্রলিটা কাঁত হয়ে আমার ছেলের গা ভিজিয়ে একাকার।এয়ার হস্টেস মেয়েটা হিস্টিরিক হয়ে গলা ফাটিয়ে কান্না জুরেছে।সারা প্লেনের কার্পেট কোল্ড ড্রীঙ্কসে ভিজে চট চট হয়ে আছে। চারিদিকে ছিটানো খাবার জিনিষে সয়লাব ।আমার ছেলে আলভী আমার কাঁধ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছেঃ "পাপা দেখো ইনশাল্লাহ কিছছু হবেনা"। আমি বুঝতে পারছি, এ মিথ্যে সান্ত্বনা, কারন আমরা প্রচণ্ড গতিতে গুত্তা খেয়ে নিচের দিকে নেমে চলছি।

আমার একটা ভোঁতা আনুভুতি -কোন ভাল-মন্দ বোধই হচ্ছিলোনা, শুধু ইংরেজি চলচিত্রের দেখা কিছু প্লেন ক্রাশের সিন মনে পরে মনে হচ্ছিল নিজেই ওই দৃশ্যে অভিনয় করছি।

Inertial force, Gravitational force, যেটাই কাজ করুক না কেন, প্রচণ্ড ঝাকির সাথে পতনের গতিতে বুঝতে পারছি, আর বড় জোর 'মিনিট দুয়েক'! তার পর মায়ানমারের কোন পাহাড়ে আছড়ে পরতে যাচ্ছি ।

সময় যেন আমাদের জন্যে ফ্রিজড্ হয়ে আছে, শুধু অক্লান্ত নিন্ম গতি। হঠাৎ করেই মনে হল সম্ভবত শেষ চেষ্টা হিসাবে পাইলট প্লেনটাকে দুর্বল ভাবে আবার সোজা করতে চাচ্ছে। বারকয়েক প্রচেষ্টায় সম্ভবত সফলও হোল। আর এই গোটা ব্যেপারটা ঘটে গেল দেড় কি দুই মিনিটের মধ্যে। পরে শুনলাম এই অবর্ণনীয় "এক" বা "দেড়" মিনিটে আমাদের পতন হয়েছে ৭,০০০ ফিট !!! "টারবুলেন্স" এর কারনে স্বাভাবিক উচ্চতা পয়ত্রিশ হাজার ফিট থেকে নেমে আমাদের গতিপথ পঁচিশ হাজার ফিটে ছিল, সেখান থেকে মুহূর্তের মধ্যে সাত হাজার ফিট পতনের পর, কোন রকমে আঠার হাজার ফিটে 'স্টেব্যল' হয়েছি। ষাটোর্ধ সাদা চামড়ার অতিশয় অভিজ্ঞ চালক বিমানটির শেষ রক্ষা করতে হয়তো সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু আমার মনে পবিত্র কোর'আনের সূরা নাহাল এর একটি আয়াতই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছিলঃ "তারা কি উড়ন্ত পাখীকে দেখে না? এগুলো আকাশের অন্তরীক্ষে আজ্ঞাধীন রয়েছে। আল্লাহ ছাড়া কেউ এগুলোকে আগলে রাখে না। নিশ্চয় এতে বিশ্বাসীদের জন্যে নিদর্শনবলী রয়েছে"।

Do they not see the birds controlled in the atmosphere of the sky?
None holds them up except Allah. Indeed in that are signs for a people who believe.
Sura An-Nahl [16:79]

ভ্রমন কাহিনী সত্যি ঘটনা