বেলা প্রায় তিনটে বাজে,শহরের সব থেকে প্রখ্যাত ডাক্তার ড: স্বপ্না রায় এবার ক্লিনিক শেষ করে ওপরে নিজের ফ্লাটে যাবার কথা ভাবছেন এমন সময় একটা ধূলি ধুসরিত মারুতি ভ্যান এসে দাঁড়ালো ওনার ক্লিনিকের সামনে, মনে হয় অনেক দূর গ্রাম থেকে এসেছে, অনেক লোক জন নামলো গাড়ি থেকে তার মধ্যে একটি মহিলা প্রায় দৌড়ে ডাক্তারের চেম্বারে এসে বল্লো “ডাক্তার মেমসাহেব আমার ছেলের বৌকে একটু দেখুন ব্যাথায় খুব কষ্ট পাচ্ছে. ড: রায় নিজের স্টাফকে বললেন স্ট্রচারে করে পেসেন্ট কে নিয়ে আসতে. রোগিনিকে আনা হলে উনি দেখলেন মেয়েটি বয়স আঠার উনিশ হবে, প্রসব ব্যাথায় খুবই কাতর . ওনার সিনিয়র সিস্টর রাধাকে ডেকে পাঠালেন এবং মেয়েটিকে ওটিতে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন .ড; রায় খুবই অপছন্দ করেন এই অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে হওয়া এবং মা হওয়া কিন্তু প্র্ত্যন্ত গ্রামের লোকজনকে কিছুতেই বোঝাতে পারেননা যে অল্প বয়সে মেয়েদের মা হওয়ার কত ঝক্কি কতটা প্রাণশংসয় হতেপারে. বিরক্ত হয়ে জিগ্য়েস করলেন মেয়েটির স্বামী কে? একটি প্রায় তিরিস বছরের লোক এগিয়ে এসে বল্লো "মেমসাহেব ও আমার জরু" ডাক্তার আরও বিরক্ত স্বরে বললেন "আর এরা কারা?"রোগা লোকটি একজনকে দেখিয়ে বল্লো " ও আমার বড় ভাইয়া,আর ওই আমার দুসরা ভাইয়া আর এদিকে হমার চাচার লেড়কা আর হমার মা " ড: রায় কেবল মেয়েটির স্বামীকে ভিতরে আসতে বলে নিজে ভিতরে চলে গেলেন বাইরে ট্যূলে মনুয়া বসে বসে নিজের মনেই বল্লো "আজ আমার সার্কাস দেখার বারটা বাজলো " এই মনুয়ার বয়স বছর দশ হবে এবাড়িতে ওর অবাধ গতি ডাক্তার মেমসাহেব ওর মাই . এবাড়ীতে ওর আসাও একটা ঘটনা . বেশ কয়েক বছর আগে একদিন ড: রায় রুগী দেখে বাড়ি ফিরছিলেন, গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে ওনার ব্যাগটা পড়ে গিয়েছিলো ,ব্যাগটা তুলতে গিয়ে দেখেন একটি বাচ্চা ছেলে ওটি তুলে দিয়ে বল্লো “আমাকে খেতে দেবে? বড়ো ভূক লেগেছে” .ড রায় নিজেও খাননি বেলা অনেক হয়েছে বাচ্চাটিকে দেখে মায়া হলো বললেন “ চল ভিতরে” ওপরে গিয়ে নিজে বসলেন ডাইনিং টেবিলে, পাসে মাটিতে ছেলে টিকে খেতে দিতে বললেন রান্নার মহারাজকে. ছেলের খাওয়া দেখে হাঁসবেন কী কাঁদবেন বুঝতে পারচেন না ছেলেটি দুহতে মুঠো করে শুধু ভাত মুখে পুরছে. উনি বকলেন “ কী রে এরকম করে কেউ খায় ?” ছেলেটি বলে উঠলো " অনেক দিন খানা খাইনিতো" ! শুনে ড: রায়ের চখে জল এসে গেলো জিগ্য়েস করলেন “কেনো তোর মা বাপ কোথায় গেলো ?’ বাচ্চাটি বল্লো " উলোগ বাড়মে বহি গেলো” উত্তর শুনে ওনার গা শিউরে উঠলো " ড: রায় বললেন "তুই কোথায় যাবি এখন?" মাথা নাড়িএ বল্লো " নাহি জানে" ওর কথা শুনে মমতায় ভরে উঠলো নি:সন্তান ড: রায়ের মন . বললেন তুই এখানে থাকবি?খুসি হয়ে মাথা হেলিয়ে বল্লো “জরুর রহবে " ড: রায় হেঁসে বললেন “ চুরি করবি না তো?” এক গাল হেঁসে বল্লো “ বাবুজি বলেছে মাঙ্গকে খাবি চুরি নাহি করবি”. সেই থেকে মনুয়া রয়ে গেছে এই বাড়িতে .সকলে ওকে ড; রায়কে মাতাজি বলতে শিখিয়েছিলো কিন্তু ও ওনাকে মাই বলে ডাকে.
ওনার বেড রুমের দরজার পাসে খাট বিছিয়ে ঘুমোয আর সকাল থেকে মাই এর কাজ করে, এটা সেটা সবেতেই মনুয়া না হলে হবে না, সকালে ব্রেকফাস্ট না করেই রুগী দেখতে চলে গেছেন ডাক্তার, ট্রে নিয়ে সুখিয়া রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ে ভিতরে যাবে না, মনুয়া হাত থেকে ট্রে নিয়ে সোজা ভিতরে গিয়ে বলে "মাই আগে খেয়ে নাও নইলে তোমার শরীর খারাপ হলে রুগিরা কোথায় যাবে বলো"? ড: রায় ও চুপচাপ ব্রেকফাস্ট খেয়ে নেন,এমন অবাধ গতি মনুয়ার. আজ এই বেলা তিনটায় রুগী দেখে ওর মন খারাপ ওর আজ ছুটি আর পয়সা নেওয়া আছে মাইএর কাছে, সার্কাস দেখার জন্য. ওর ওটিতে কোনো কাজ নেই কিন্তু মাই ওপরে না গেলে ওতো কোথাও যাবে না .
মেয়েটির স্বামীকে দিয়ে সাইন করিয়ে ওটিতে ঢোকেন পেসেন্টকে দেখে মায়া হয়, রোগা পাতলা মেয়েটি প্রথম প্রসব যন্ত্রণায় কাতর .চেকআপ করে বুঝলেন বাড়িতে ওকে অশিক্ষিত দাইকে দিয়ে চেষ্টা করে যখন পারেনি তখনি ওনার চেম্বারে এনেছে, বেশ কমপ্লিকেসন আছে। রাধাও পাসে সাহায্য করার জন্য তৈরি রয়েছে .নিজের কাজে নেমে পড়লেন, অনেকক্ষণ যুদ্ধ করার পর একটি সুন্দর ছেলে পৃথিবীর আলো দেখলো. ডাক্তার নি:স্বাস ফেলে রাধার হতে বাকি কাজ দিয়ে ওপরে গেলেন. মনুয়া ও পিছন পিছন ওপরে গেলো ওর সার্কাস দেখার প্রোগ্রাম নষ্ট হলেও ওর মনে খুশি ভরা ছিলো. ওর মাইএর কাজ শেষ হলো .
পরের দিন রুটিন মতো সব কিছু চলছিলো হটাত্ রাধা এসে বল্লো "ম্যাডাম নীচে দেখুন গোলমাল” ড: রায় “আবার কী হলো প্রথম ছেলে তো হয়েছে আবার কী প্রবলেম ? বাড়ির লোক টাকা পয়সা নিয়ে ঝামেলা করছে নাকি ?’ “না ম্যাডাম আপনি চলুন’ .রেডী হয়ে নীচে এলেন ড: রায় নীচে নামার সময়ই শুনতে পেলেন নবজাত শিশুর কান্না . বুঝতে পারলেন না কী ব্যাপার .কাল তো শিশুটির স্বাস্থ্য , ওজন ইত্যাদি ঠিকই ছিলো আজ কী হলো? বেডএর কাছে গিয়ে দেখলেন সদ্য প্রসুতা মা বসে আছে শিশূটী শাশুডির কোলে ,মায়ের মুখ কালো , শাশুডী অনুনয় বিনয় করছে বাচ্চাটিকে কোলে নেওয়ার জন্য কিন্তু মা বাচ্চাটিকে নেবেনা. এরকম অবস্থা আগে কখনো হয়নি. ডাক্তারও অবাক হয়ে গেলেন . উনি কাছে গিয়ে মেয়েটির নাম জিগ্য়েস করলেন মেয়েটি ঠিক ঠাক জবাব দিলো.বোল্লো আমার নাম পার্বতী . ড: রায় বললেন " তুমি ছেলেকে কোলে নিলে না কেনো? দুধ দিচ্ছো না কেনো?" উত্তর শুনে হতচকিত হয়ে গেলেন " ও আমার ছেলে নয় " অবাক হয়ে বললেন তোমার ছেলে নয় ? কী বলছো ? কাল বিকলে এতো যুদ্ধ করে, এতো সুন্দর ছেলে পেয়েছো আর বলছো তোমার ছেলে নয় একি কথা ? পার্বতী প্রবল আপত্তি করে চেঁচিয়ে বল্লো " না ও আমার ছেলে নয় " রাধা বলে উঠলো "দেখুন না ম্যাডাম সমানে একই কথা বলে চলেছে, কিছুতেই বাচ্চাকে দুধ দেবে না , বাচ্চা তো খিদেতে কাঁদছে কিছুতেই শুনবে না তাই তো আপনাকে ডেকে আনলাম "ডাক্তার এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কী করবেন বুঝতে পারছেন না উনি পার্বতীর শাশুরীকে জিগ্য়েস করলেন " মেয়েটির কী মাথার দোষ আছে? পাগলামি করে? শাশুডী বললেন ওর কোনো পাগলামীর লক্ষণ নেই একেবারে সাধারণ মেয়ে তবে খুব কম কথা বলে . ডাক্তার চিন্তায় পড়ে গেলেন .কী হতে পারে ? কেনো এরকম করছে পার্বতী ? একবার ভাবলেন ওনার বন্ধু সাইক্রিয়াটিস্ট ড: রঞ্জনকে ডাকবেন . আবার ভাবলেন একবার নিজেই একা ওর সঙ্গে কথা বলে দেখবেন. কিন্তু সর্বপ্রথম বাচ্চাটিকে দুধ দেওয়া প্রয়োজন ,রাধাকে ডেকে বাচ্চার দুধের জোগাড় করতে বললেন. চেম্বারে বসে অন্য রুগী দেখতে দেখতে কেবল পার্বতীর কথা মনে করতে লাগলেন, কী এমন হতে পরে যেজন্য পার্বতী এরকম ব্যাবহার করছে? কিছুতেই কোনো পরিণতিতে আসতে পারছেন না, নিজের কাজে মন দিতে পারলেন না, মনুয়াকে ডেকে বললেন বাকি পেসেন্টদের আজ চলে যেতে বলতে. উনি আবার পার্বতীর কাছে এলেন .একটু দূর থেকে নজর করলেন ,পার্বতী চুপ করে শুয়ে আছে . কাছে কেউ নেই .কিছুক্ষ্ণন দেখে ওর স্বামিকে ডেকে পাঠালেন . নিরীহ খুবই রোগা লোকটি এসে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইল ডাক্তার ওকে বললেন " তোমার ঘরণী ছেলে পেয়ে খুশি নয় কেনো?" কী চায় সে?" লোকটি কোনো কথা না বলে নীরবে তাকিয়ে রইলো.অনেক বার একই প্রশ্ন করলেন শেষে একটা ছোট্টো উত্তর পেলেন ও আমাদের বাড়িতে সুখী নয় . কেনো সুখী নয় তার কোনো উত্তর নেই .ইতিমধ্যে লোকটির ভাইরা উঁকি মারতে লাগলো .ডাক্তার ওদের ভিতরে ডাকলেন কিন্তু কেউ এলোনা চট করে অন্য দিকে চলে গেলো .এতেও অবাক হলেন ডাক্তার এ কিরকম ব্যাবহার ?
পার্বতীর কাছে আবার গেলেন , একই ভাবে শুয়ে আছে .খুব ধীরে ডাকলেন “পার্বতী " চমকে উঠে তাকালো চোখে দু:খের ছায়া পাসে বসে ওর হাত ধরে কিছুক্ষ্ণন বসে রইলেন .পার্বতীর চোখ জলে ভরে উঠলো , কোনো কাথা নেই শুধু চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে অনেক পরে ডাক্তার বললেন “ কিছু বলবি?”পার্বতী মাথা নেড়ে জানলো না সে কিছুই বলবে না . ওকে কিছু না বলে বাচ্চাটিকে একবার দেখে চলে এলেন ওপরে নিজের ঘরে. সারা রাত ভেবে কুলকিনারা পেলেন না ঘুম হলো না তখন রাত প্রায় চারটে ডাক্তার আর থাকতে পারলেন না একবার নীচে গিয়ে পার্বতীর সঙ্গে কথা বলার জন্য নীচে নামলেন .সব রুগী ঘুমের ঘোরে . ধীর পায়ে পার্বতীর বেড এর কাছে গেলেন আশ্চর্য হয়ে দেখলেন পার্বতী নির্ঘুম চোখে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে . কাছে গিয়ে আস্তে করে গায়ে হাত দিলেন বললেন "বল না কেনো তুই এরকম করছিস বাচ্চাটা কতো কষ্ট পাচ্ছে, মা হয়ে তোর কী ভালো লাগছে? শ্বশুর বাড়ির সকলে তো তোর জন্যই এখানে রয়েছে. পার্বতী উঠে বসলো ডাক্তারের দু হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বল্লো " কী করে বলবো ও আমার ছেলে", কী করে বলো তুমি ? কে ওর বাবা ? বড়ো ভাই ,চাচার ছেলে, না শ্বশুর কে ওর বাপ্? সকলে আমাকে ছিঁড়ে খায় রাত্রে. আমি বাঁচতে চাইনা. কেনো আমাকে বাঁচলে ? ও আমার কেউ নয়. আমি জানিনা ওর বাপ্ কে ? কি করে আমি ওকে আমার নিজের বলে মানবো তুমি বলে দাও. অজস্র না বলা কথা সে বলে গেলো ,বুক ভেসে গেলো চোখের জলে . তুমি বলো ওর বাবা কে? আমাকে বাড়িতে গেলে আবার ...... আমি আর পারছি না ডাক্তার মেমসাহেব, তুমি বলো আমি কী করি?কে ওর বাবা ?আমার পতি কিছু বলতে পারেনা ও অসুস্থ, তুমি বল? আঝোর চোখের জলে ভেসে যেতে লাগলো .ডাক্তার স্তব্ধ হয়ে গেলেন স্থানূর মতো ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন. আজকের যুগে যখন কল্পনা চাওলা,আর্চনা শর্মারা মেয়েদের চোখে স্বপ্নের জাল বুনে দিচ্ছে তখন প্র্ত্যন্ত গ্রামের চেহারা দেখে ,মেয়েদের ওপর অত্যাচার দেখে মূক হয়ে গেলেন ড: রায়. কি করে স্বান্তোনা দেবেন ভেবে আকুল হয়ে গেলেন. পিঠে হাত কেউ দিলো দেখলেন মনুয়া দাঁড়িয়ে আছে.