আর যুবতী বলা যাবে না মৌকে। প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়েছেন। তাও প্রায় অনেক দিন হয়ে গেল। রেল লাইনের পাটাতনে পা ফেলে ফেলে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোচ্ছেন। জায়গাটা খুব নিরিবিলি। দূরে দূরে গ্রাম। শহর থেকে খুব বেশি দূরে না হলেও এ জায়গাটা এখনও গ্রামই। আর গ্রাম যখন, তখন ট্রেনও নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ পর পর আসে। আসার সময় দিনের বেলাতেই এক ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। আর এখন তো রাত। অবশ্য টিকিট কাটার ঝামেলা নেই। ফেরার টিকিট একবারেই কেটে নিয়েছিলেন তিনি। স্টেশনটাও খুব ফাঁকা ফাঁকা। লোকজন প্রায় নেই বললেই হয়। প্ল্যাটফর্মে ওঠার আগেই ওঁর চোখে পড়ল, ও পারে একটা রাধাচূড়া। উনি মনে মনে বললেন, বাহ্, রাধাচূড়া গাছটা তো ভারি সুন্দর। বহু দিন পর এ রকম ফুলে ফুলে ভরা গাছ দেখলাম। যাই, গাছটার নীচে, ওই বেঞ্চটায় গিয়ে বসি। উনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন।
বসতে না বসতেই মাইকে ঘোষণা। ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছে না কী বলছে। ভীষণ নয়েজি। শুধু এটুকু বুঝতে পারলেন, কোন ক্রসিংয়ে যেন ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে কখন ট্রেন আসবে কোনও ঠিক নেই। এ রকম অভিজ্ঞতা এর আগেও তাঁর বহু বার হয়েছে। সেমিনারে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে প্রায়ই এদিকে ওদিকে যেতে হয়। রাতও হয়। নাহয় আজ একটু রাতই হবে। কেউ তো বলার নেই। এ সব তাঁর এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া তাঁর শরীর জুড়িয়ে দিল। চোখ বুজে এল তাঁর। চোখ খুলতেই তাঁর মনে হল, এই স্টেশনটা যেন কেমন, অন্য আর পাঁচটা স্টেশনের মতো নয়, অনেক শান্ত, নির্জন, ফাঁকা ফাঁকা। লোকজনও কম। এমন সময় তিনি দেখলেন, একটা লোক পায়ে পায়ে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছেন।
লোকটি একদম কাছে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন ট্রেন আসছে, কিছু বলেছে?
মৌ বললেন, না, ট্রেনটা নাকি কোন ক্রসিংয়ে আটকে আছে।
--- কোন ক্রসিংয়ে?
--- ঠিক বুঝতে পারলাম না। তার পর মৌ নিজেই প্রশ্ন করলেন, এখানে ঘোষণা-টোসনা ঠিক মতো করে তো?
বেঞ্চের ও ধারে বসতে বসতে লোকটি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, করবে না কেন? তবে মাইকটা অনেক দিন ধরেই খারাপ। আমি তো মাঝে মাঝেই আসি। আপনি নতুন বুঝি?
মৌ বললেন, হ্যাঁ, আমি এখানে এই প্রথম এলাম।
--- এই প্রথম? ও... এই জায়গাটা কিন্তু খুব ভাল।
চার পাশে তাকাতে তাকাতে মৌ বললেন, তাই বুঝি?
লোকটা বললেন, হ্যাঁ, আমি তো এই জায়গাটাকে এত ভালবেসে ফেলেছি যে, প্রায়ই চলে আসি। বিশেষ করে এই দিনটায়, এই গাছটার তলায় বসে সারাটা দিন কাটিয়ে দিই। আসলে এই গাছটাকে আমি ভীষণ ভালবাসি।
মৌ একটু অবাক হয়ে উপরে গাছটার দিকে তাকালেন, এই গাছটাকে?
--- হ্যাঁ, ওর সঙ্গে কথা বলি। গল্প করি। ও সব বোঝে। চুপটি করে শোনে।
মৌ আরও অবাক। পাগল-টাগল নাকি! কী বলছে লোকটা! গাছ কথা শোনে! নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন তিনি। লোকটা তখনও বলে চলেছেন--- ও তো সব জানে। সব কিছুর সাক্ষী। সে অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন কলেজে পড়তাম। কয়েক জন বন্ধু মিলে একদিন ঠিক করলাম, আমরা গ্রাম দেখতে বেরোব। আমি, গীতি, তরু, কাকলি, নম্রতা, সোনম আরও একজন ছিল...
লোকটার কথা শুনে মৌয়ের যেন কেমন লাগল। লোকটা যে নামগুলো বলছে সেগুলো ওর খুব চেনা চেনা। কিছু কিছু মনেও পড়তে লাগল তাঁর। উনি বললেন, গ্রাম দেখতে? আপনি কোন কলেজ পড়তেন? --- নিউ আলিপুর কলেজে।
মৌয়ের চোখেমুখে এক ঝলক আলো খেলে গেল, নিউ আলিপুর? আপনি কি পিউল?
লোকটি একটু হাসলেন, চিনতে এতক্ষণ লাগল? আমি কিন্তু তোমাকে প্রথমেই চিনতে পেরেছি।
--- সে কী? তা হলে বলেননি কেন?
--- দেখছিলাম চিনতে পারিস কি না...
এক মুখ খুশি নিয়ে মৌ বললেন, তাই তো বলছি, কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু দুম করে কি কাউকে জিজ্ঞেস করা যায়?
--- একদম অপরিচিত কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না ঠিকই, কিন্তু স্কুল কলেজের পুরনো বন্ধুদের বেলাতেও কি তাই?
মৌ যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন--- না, আসলে আপনাকে প্রথমে ঠিক...
--- আপনি! সে কী রে! আগে তো 'তুই' করে বলতিস, এখন হঠাৎ আপনি-আজ্ঞে?
আমতা আমতা করে মৌ বললেন, না, আসলে অনেক দিন পর তো...
মৌয়ের মুখের দিকে তাকালেন পিউল, অনেক দিন পর...
--- অনেক দিন না? লাস্ট কবে দেখা হয়েছে বল তো, সেই নাইন্টিন সেভেনটি...
পিউল ওঁকে কথা শেষ করতে দিলেন না। তার রেশ টেনেই বললেন, সেভেনটি ওয়ানের থার্টিনথ মার্চ, সন্ধ্যা ছ'টা কুড়ি কি বাইশ... দোলের ঠিক আগের দিন...
মৌ একটু থমকে গেল, তোর দেখছি সব মনে আছে...
পিউল বললেন, সব সব সব।
অভিযোগের সুরে মৌ বললেন, পরদিন তো তোর আসার কথা ছিল। বলেছিলি, বিকেলের দিকে আসবি। তার পর যে কোথায় হারিয়ে গেলি! কত খোঁজ করেছি, কত লোকের কাছে তোর কথা জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু কেউই বলতে পারেনি। একদিন তো গীতি, তরু, কাকলি, শ্যামা, আমরা সবাই মিলে তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তোর বাবাও বলতে পারলেন না, তুই কোথায়...
পিউল ধীরে ধীরে বললেন, সে দিন তোর সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফেরার পথে আমাকে পুলিশে ধরল...
মৌ সোজা হয়ে বসলেন, পুলিশ?
--- হ্যাঁ পুলিশ। মনে পড়ে সেই সময়ের কথা? সারা দেশ তখন উত্তাল। বাড়ি থেকে কেউ বেরোলে, যতক্ষণ না সে ফিরছে, কেউ বলতে পারত না, সে আদৌ বাড়ি ফিরবে কি না। মনে পড়ছে?
--- কিন্তু তুই তো কোনও রাজনীতি করতিস না...
--- তখন কি কোনও রাজনীতি-টিতি লাগত? তবু ভাগ্য ভাল বলতে হবে, আমাকে ধরার খবরটা কী করে যেন বাবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। না হলে তো থানার খাতায় উলটোপালটা নাম লিখে মাঝরাতে শুনশান রাস্তায় নামিয়ে বলত, পালা। যেই পালানোর জন্য দৌড়তাম, অমনি পিছন থেকে গুলি... পরে জিপে করে আশপাশের কোনও নদী বা নালায় ফেলে দিয়ে আসত। কেউ কিছু বললে বলত, ওরা পালাচ্ছিল, তাই গুলি করেছি।
--- তার পর?
--- খবর পেয়েই বাবা ছুটে এসেছিলেন। তিনিই একে-তাকে ধরে, বলে-কয়ে আমাকে রেসকিউ করে রাতারাতি শঙ্কস টি গার্ডেনে পাঠিয়ে দেন। আলিপুরদুয়ার থেকে পঁয়তিরিশ কিলোমিটার দূরে, মামার বাড়িতে...
--- একটা ফোন তো করতে পারতিস...
পিউল ওঁর দিকে তাকালেন, কী ভাবে দুটো জামাকাপড় কিটব্যাগে ভরে তড়িঘড়ি ট্রেন ধরেছিলাম, তা আমিই জানি। টেলিফোনের ডায়েরিটা পর্যন্ত নিতে পারিনি। তা ছাড়া তখন তো আর অলিতে-গলিতে দু'হাত দূরে দূরে এ রকম টেলিফোন বুথ ছিল না যে, যখন খুশি ফোন করব। নাকি মোবাইল ছিল, বল? থাকলে তো, যে কথাটা একজনকে বারবার বলতে চেয়েছিলাম, অথচ কোনও দিন বলতে পারিনি, সে কথাগুলো তো এসএমএস করে অনায়াসেই তাকে পাঠিয়ে দিতে পারতাম।
মৌ অবাক, কাকে?
--- সে একজন ছিল।
--- কী কথা?
--- নাহ্, থাক। সেগুলো এখন আর বলা যাবে না। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
গলার স্বর নামিয়ে মৌ বললেন, এমনও তো হতে পারে, সেই কথাগুলো শোনার জন্যই হয়তো সে এখনও মুখিয়ে আছে।
পিউল ঝট করে মৌয়ের দিকে তাকালেন, এখনও!
মাটির দিকে চোখ নামিয়ে মৌ মাথা নাড়ল--- হ্যাঁ।
একটা মাত্র শব্দ। কিন্তু সেটা শুনেই পিউলের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল--- তুমি বুঝতে পারতে?
--- কেন বুঝতে পারব না? তুমি কি কঠিন অঙ্কের চেয়েও জটিল ছিলে নাকি?
--- কিন্তু আমি তো তোমাকে নিজের মুখে কোনও দিন কিছু...
--- কিছু কিছু কথা বলার দরকার হয় না। বরং না বলাটাই বলার চেয়ে অনেক বেশি বলা।
--- তুমি বুঝলে কী করে?
--- বোঝা যায় মশাই, বোঝা যায়। তোমার মনে আছে, অফ পিরিয়ডে আমরা কলেজের মাঠে বসে আড্ডা মারতাম। কোনও কোনও দিন বাচ্চাদের মতো খেলতাম। কোনও দিন রুমাল চোর, কোনও দিন অন্ত্যাক্ষরী, আবার কোনও দিন ব্যাডমিন্টন...
--- মনে থাকবে না আবার?
--- তোমার হয়তো মনে নেই। আমরা একদিন কানামাছি খেলছিলাম। হঠাৎ তুমি বললে, মৌ খেলবে না। আমি তো অবাক। আমি আবার কী করলাম! সে দিন সত্যি সত্যিই তুমি আমাকে খেলতে নাওনি। পরদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কাল ও রকম করলে কেন? তুমি বলেছিলে, তোমাকে অন্য কেউ ছুঁক আমি চাই না।
পিউল ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, সে কথা তোমার মনে আছে?
--- সব, সব মনে আছে। তোমার মনে আছে, তোমার ছোট বোনের জন্মদিনে আমাদের নেমন্তন্ন করেছিলে। আমাদের যেতে দেরি হচ্ছিল দেখে তুমি একটা কবিতা লিখে ফেলেছিলে...
পিউল বাচ্চাদের মতো হেসে উঠলেন। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, পরে তা নিয়ে কলেজে কী হাসাহাসি...
--- কবিতাটা কিন্তু আমার এখনও মনে আছে।
পিউলের চোখ দেখে মৌয়ের মনে হল পিউল বুঝি ওঁর কথা বিশ্বাস করছে না। তাই আবৃত্তির মতো করে উনি বলতে লাগলেন সেই কবিতাটা--- মৌ আজ আমার বাড়ি আসবে।/ আকড়া স্টেশন থেকে বারুইপুর/ ও রাস্তা, তুমি নিজেকে গুটিয়ে একটু ছোট করে নাও/ না হলে, এতটা পথ আসতে/ ওর যে অনেক সময় লেগে যাবে!/ ও রাজহংস মেঘ/ তোমার ডানা দিয়ে সূর্যকে তুমি একটু আড়াল করে রাখো/ ও কক্ষনো ছাতা রাখে না সঙ্গে/ এই ভরদুপুরে ও যদি আসে!/ ও কামরূপ-কামাখ্যা/ রক্ষাকবচ দিয়ে তুমি ওর চারদিকে বলয় তৈরি করে দাও/ যাতে কোনও কিছুই ওকে ছুঁতে না পারে।/ ও আজ আমার বাড়ি আসবে/ ও আজ আমার বাড়ি আসবে/ ও আজ আমার বাড়ি আসবে...
পিউল থ' হয়ে গেলেন। তোমার এখনও পুরোটা মনে আছে!
--- বাহ্, আমাকে নিয়ে লিখেছ, আর আমার মনে থাকবে না? তারপর আর কোনও কবিতা লেখোনি?
পিউল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, নাহ্, ওটাই আমার প্রথম, ওটাই আমার শেষ কবিতা।
--- কেন? লেখোনি কেন?
পিউল একটু থেমে বললেন, তুমি থাকলে হয়তো লিখতাম। আরও কী সব বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ট্রেনের ঘোষণা ভেসে এল। ওরা দু'জনেই কান পাতলেন। শুনলেন, শিয়ালদহ যাওয়ার গাড়ি আপ ক্যানিং লোকাল দু'নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে...
--- ওই যে... ট্রেন আসছে...
--- হ্যাঁ। এত দিন বাদে সত্যিই খুব ভাল লাগল, এত দিন পরেও তোমার অনেক কিছু মনে আছে দেখে।
--- অনেক কিছু নয়, সব, সব।
পিউল বললেন, না, সব বোধহয় নয়।
মৌ মুচকি হেসে বললেন, যেমন...
--- এই যে একটু আগে তুমি বললে, এই স্টেশনে তুমি এই প্রথম এলে...
--- হ্যাঁ, ঠিকই তো, এর আগে... কই... না তো...
--- না, এটা বোধহয় ঠিক নয়...
--- কেন?
--- মনে করে দেখো। কলেজ থেকে দল বেঁধে আমরা একবার গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিলাম। মনে আছে?
--- হ্যাঁ।
--- কোন স্টেশনে নেমেছিলাম, নামটা মনে আছে?
--- না, নামটা মনে নেই, সেই কবেকার কথা! কেন বলো তো?
--- এটা সেই স্টেশন।
মৌ আকাশ থেকে পড়লেন। না না, সেটা তো কেমন ছিল যেন। মাটির প্ল্যাটফর্ম, একদম নির্জন, চারদিকে শুধু ধানখেত। আশপাশে কোনও বাড়িঘর ছিল না...
--- হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, তখন ও রকমই ছিল। কিন্তু এর মধ্যে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, খেয়াল আছে?
মৌ দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন, এটা সেই স্টেশন!
--- হ্যাঁ, এটা সেই স্টেশন। তোমার মনে আছে, ফেরার সময় রাহুল একটা ইটের টুকরো দিয়ে কার বাড়ির মাটির দেওয়ালে নিজের নাম আর তারিখ লিখছিল, সেটা দেখে...
মৌ লাফিয়ে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে বৃষ্টি হলেই তো ওটা মুছে যাবে, সত্যিই যদি কোনও চিহ্ন রেখে যেতে চাস, তা হলে এমন কিছু কর, যেটা পঞ্চাশ বছর পরেও থাকবে। বলেই, তুমি একটা গাছের চারা কোথা থেকে এনে প্ল্যাটফর্মের পাশে লাগিয়ে দিয়েছিলে!
--- ওটা ছিল কৃষ্ণচূড়া। আমার দেখাদেখি তুমিও আর একটা চারা এনে ঠিক তার উলটো প্ল্যাটফর্মে লাগিয়ে দিয়েছিলে।
--- হ্যাঁ হ্যাঁ...
--- সেটা ছিল রাধাচূড়া। আমরা এখন যে গাছটার নীচে বসে আছি, এটা সেই গাছ।
মৌ অবাক। তাই নাকি? তা হলে তো এর উলটো দিকে ওই প্ল্যাটফর্মে তোমার কৃষ্ণচূড়াটা থাকার কথা। সেটা কোথায়?
--- মরে গেছে বোধহয়। কথা ক'টা পিউল এমন ভাবে উচ্চারণ করলেন যে, পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠছিল। এমন সময় আবার মাইকে ঘোষণা--- শিয়ালদহ যাওয়ার গাড়ি আপ ক্যানিং লোকাল দু'নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে...
--- এত তাড়াতাড়ি!
পিউল জানতে চাইলেন, তুমি কোথায় যাবে?
--- কলকাতা। তুমি?
--- আমি যাব উলটো দিকে।
কথায় কথায় মৌ ফিরে গেলেন পুরনো প্রসঙ্গে--- আচ্ছা, পরে যখন তুমি ফিরে এলে, তখন যোগাযোগ করলে না কেন?
--- করেছিলাম। তত দিনে তোমরা ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছ।
--- সে তো অনেক পরে।
--- তা হবে... পিউল কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন।
--- একটা চিঠি তো লিখতে পারতে?
--- তোমার বাড়ি চিনতাম ঠিকই, কিন্তু পোস্টাল অ্যাড্রেস তো জানতাম না। তোমরা যে হুট করে এই ভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, জানব কী করে?
মৌ ধীরে ধীরে বললেন, যে শহরে তুমি নেই, অথচ তোমার স্মৃতি আছে, সেখানে আমি থাকি কী করে?
পিউল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, আবার ছেদ টেনে দিল ট্রেনের ঘোষণা--- শিয়ালদহ যাওয়ার গাড়ি আপ ক্যানিং লোকাল দু'নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে...
মৌ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ট্রেন কখন?
--- দেরি আছে। আমি এখানে আরও কিছুক্ষণ থাকব। তোমাকে বললাম না, প্রতি বছর এই দিনটা আমি এখানে, এই গাছটার সঙ্গে কাটাই...
--- হ্যাঁ, সে কথা তো একটু আগেও তুমি বললে, কিন্তু কেন?
--- তোমার হয়তো খেয়াল নেই, এই দিনটাতেই তুমি এই গাছের চারাটা লাগিয়েছিলে...
মৌ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে এল একটা শব্দ--- তাই!
মৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে উনি বলে উঠলেন, এই গাছের নীচে বসলে আমি তোমার গায়ের গন্ধ পাই। মনে হয়, তুমি আমার কাছেই আছ...
মৌয়ের চোখ ছলছল করে উঠল, এ কী বলছ তুমি!
পিউল আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বললেন, যে কথা কোনও দিন বলতে পারিনি...
বাকি কথা আর শুনতে পেলেন না মৌ। ট্রেন ঢুকে পড়ল স্টেশনে। সে দিকে তাকিয়ে পিউল বললেন, ওই যে তোমার ট্রেন এসে গেছে।
মৌ উঠে দাঁড়িয়ে ট্রেন ধরার জন্য এগিয়ে যেতেই, হঠাৎ খেয়াল হল, ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো তাঁর কাছে কিছু নেই। না ঠিকানা। না কোনও ফোন নম্বর। তাই মৌ বললেন, তোমার ফোন নম্বরটা দেবে?
পিউল বললেন, এইট সেভেন সেভেন সেভেন এইট...
কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলা ব্যাগ থেকে পেন আর ডায়েরি বার করতে যাচ্ছিলেন মৌ, কিন্তু বার করবেন কি, ট্রেনটা যে এক্ষুনি ছেড়ে দেবে। পিউল বললেন, উঠে পড়ো, উঠো পড়ো। এর পর আর কোনও ট্রেন নেই। এটাই লাস্ট ট্রেন...
ট্রেনের কামরায় পা রেখে নিজেকে সামলাতে সামলাতে মৌ বললেন, তোমার নম্বরটা...
পিউল আবার বললেন, এইট সেভেন সেভেন সেভেন এইট...
মৌ তাঁর ডায়েরিতে লিখতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দিল। দরজার সামনে ও ভাবে দাঁড়িয়ে লিখতে গেলে যে-কোনও সময় হাত ফসকে পড়ে যেতে পারেন। তাই ট্রেনের সঙ্গে বড় বড় পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে পিউল বললেন, ভেতরে ঢোকো, ভেতরে ঢোকো।
মৌ বললেন, শুনতে পাচ্ছি না, জোরে বলো, জোরে...
পিউল আরও জোরে জোরে বলতে লাগলেন, এইট সেভেন সেভেন সেভেন এইট... মনে থাকবে? এইট সেভেন সেভেন সেভেন এইট... লেখো লেখো, এইট সেভেন সেভেন সেভেন এইট...
মৌ যে কামরাটায় উঠেছিলেন, সেই কামরাটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওঁর আর বলা হল না তাঁর মোবাইল নম্বরের বাকি সংখ্যাগুলো। ঠায় তাকিয়ে রইলেন চলে যাওয়া ট্রেনটার দিকে।
সিদ্ধার্থ সিংহ আশির দশকের সব্যসাচী লেখক। জন্ম কলকাতায়। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। বড়দের এবং ছোটদের জন্য লেখেন কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, সম্পাদকীয় এবং প্রচ্ছদ কাহিনি। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। আইসিএসসি এবং সিবিএসসি বোর্ডের প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। বানিয়েছেন দু'টি তথ্যচিত্র। লিখেছেন বেশ কয়েকটি ছায়াছবির চিত্রনাট্য। তাঁর গল্প নিয়েও সিনেমা হয়েছে। এক সময় আনন্দবাজার সংস্থায় সাংবাদিকতা ছাড়াও নিয়মিত মডেলিংয়ের কাজও করেছেন। ছড়া, কবিতা, অণুগল্প, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, শিশুতোষ, প্রচ্ছদকাহিনি, সম্পাদকীয়, অ্যাঙ্কার স্টোরি এবং বিষয়ভিত্তিক মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তিনশো ঊনষাটটি বই। বিভিন্ন ভাষা থেকে অনুবাদও করেছেন। প্রবর্তন করেছেন 'রতিছন্দ', 'রিয়্যালিটি উপন্যাস' এবং 'ঝলক-গল্প'র। এই কথাসাহিত্যিক একক ছাড়াও, যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ কুমার চক্রবর্তী, শুভঙ্কর সিংহের সঙ্গে এক হাজার এগারোটি সংকলন। ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' এবং ২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' সম্মানে ভূষিত হন। পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার।