কলকাতার কুয়াশাভেজা এক সকালে, ঘড়ির কাঁটা তখন
সাতটা ছুঁইছুঁই, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পেছনের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো
এক বয়স্ক লোক। বয়স সত্তরের কোঠায়, ধবধবে সাদা চুল, পরনে সাদামাটা ধুতি-পাঞ্জাবি, আর হাতে একখানা সবুজ
রঙের পেন। দেখতে খুব সাধারণ, যেন প্রতিটি দিন এখানেই শুরু হয় তার, কিন্তু আজকের সকালটা
ছিল অন্যরকম।
হঠাৎ সে থেমে দাঁড়াল, মাটিতে পড়ে থাকা একটা পুরোনো চিঠি তুলে নিল। খামে লেখা — “প্রিয় শর্মিষ্ঠা, সবুজ পেনটা দয়া করে আর কাউকে দিও না। এর মধ্যে যেটা আছে, সেটা একটা জীবন পাল্টে দিতে পারে, আবার কেড়ে নিতে পারে বহু জীবনও।”
লোকটি হাসল। ঠোঁটের কোণে একরকম বাঁকা হাসি, যেটা বুক কাঁপিয়ে দেয়। সে চিঠিটা পকেটে ভরে পেনটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল — তারপর হঠাৎই হারিয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে।
গল্পের সময়টা সাতদিন আগে।
মৃণাল সেন রোড, কলকাতা।
স্নেহাশিস মুখার্জি, এক কেজি দুধ নিয়ে ফিরছিলেন বাড়ি। সরকারি অফিসার, সদ্য রিটায়ার্ড, বয়স পঞ্চান্ন। স্ত্রী মারা গেছেন তিন বছর আগে, একমাত্র ছেলে রাহুল চাকরির সন্ধানে দিল্লিতে। স্নেহাশিসবাবুর জীবনের একমাত্র সঙ্গী — লেখালিখি। গল্প, কবিতা, কখনও কখনও গোয়েন্দা উপন্যাস লিখে সময় কাটান। নিজের ঘরের জানালার ধারে বসে লিখতে ভালোবাসেন। সেইদিন বিকেলে, হঠাৎ করেই ডাকবাক্সে একটা ছোট প্যাকেট পান।
খুলে দেখেন — একটা সবুজ পেন। সঙ্গে একটা ছোট্ট চিরকুট:
"এই পেন শুধু সত্য লিখে। তুমি কি সত্যি সাহসী?"
স্নেহাশিসবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন এটা কারও মজা। কিন্তু কৌতূহল তাকে গ্রাস করে। তিনি একটা সাদা কাগজ টেনে আনেন, আর সেই সবুজ পেনটা দিয়ে লিখতে শুরু করেন — “আজ সকাল থেকে আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।”
সেই মুহূর্তেই ঘরের জানালার বাইরে একটা কালো ছায়া সরে গেল।
পরের দিন, স্নেহাশিসবাবু থানায় গেলেন। তবে পুলিশ গুরুত্ব দেয়নি। তারা হেসে বলেছিল, “রিটায়ার্ড মানুষদের কল্পনা শক্তি অনেক বেড়ে যায়। আপনি বিশ্রাম নিন, সাহেব।”
স্নেহাশিস ফিরে এসে আবার লিখতে শুরু করেন। কিন্তু এবার যা ঘটল, তা অকল্পনীয়। তিনি লিখলেন:
“আজ রাত ১টায় দক্ষিণ কলকাতার এক গলিতে একজন খুন হবে। খুনের অস্ত্র—ছুরি। খুনি পরনে কালো পাঞ্জাবি পরা। নাম—রাকেশ মল্লিক।”
তারপর আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে খবরের কাগজ খুলতেই তার বুক কেঁপে উঠল। ঠিক ওই জায়গায়, ওই পোশাকে, ঠিক ওই সময় খুন হয়েছে একজন। খুনির নাম — রাকেশ মল্লিক!
স্নেহাশিস হতভম্ব হয়ে গেলেন। পেনটা কি ভবিষ্যৎ বলতে পারে? না কি যেটা তিনি লেখেন, সেটা সত্যি হয়ে যায়?
তিন দিন পার হলো। পেনটা দিয়ে তিনি আবার লিখলেন — “রবিবার দুপুরে বাড়ির কাছের হরিদেবপুর মোড়ে একটা ব্যাংক ডাকাতি হবে। চারজন ডাকাত, দুইজন পুলিশ আহত হবে।”
সোমবারের কাগজে ছবিসহ খবর ছাপা হলো — হরিদেবপুর ব্যাংক ডাকাতি, হুবহু ঘটনা মিলেছে।
এবার তিনি বুঝলেন, এই পেন সাধারণ কিছু নয়।
স্নেহাশিসবাবু কাউকে কিছু বলেন না। কিন্তু নিজের মনেই ঠিক করেন — এবার তিনি একজন পুরোনো বন্ধু, প্রাক্তন গোয়েন্দা সুব্রত বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। সুব্রত এখন অবসর জীবনে, কিন্তু মাথার ধার এখনো আগের মতোই তীক্ষ্ণ।
সুব্রত সব শোনার পর বলে, “এই পেন যদি তোমার লেখা সত্যি করে দেয়, তাহলে এটা একটা ভয়ঙ্কর অস্ত্র। কোনো অপরাধীর হাতে এটা পড়লে—ভেবেছো কী হতে পারে?”
স্নেহাশিসবাবু ধীরে বলেন, “তবে কি পেনটা নষ্ট করে দেবো?”
সুব্রত মাথা নাড়ে। “না। বরং এটা কোথা থেকে এসেছে, কে পাঠিয়েছে, সেটা বের করতে হবে। এইসব জিনিস হঠাৎ আসে না।”
এরপর শুরু হলো তদন্ত। সুব্রত বসু যোগাযোগ করলেন এক রহস্য পত্রিকার সম্পাদক অর্জুন পাল-এর সঙ্গে, যিনি সম্প্রতি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন “মননীয় বস্তু এবং ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ” নিয়ে।
অর্জুন বলেন, “এইসব জিনিস অনেক সময় পরীক্ষামূলক প্রকল্পের অংশ হয়। হয়তো এটা কোনও মানসিক নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির একটা প্রতিফলন। কিন্তু আপনি বলছেন এটা শুধু সবুজ পেন দিয়ে হয়, অন্য পেন নয় — তাহলে এটা বস্তুগত রহস্য।”
তাদের অনুসন্ধান নিয়ে যায় একটি পুরোনো লেখকের কাছে — শর্মিষ্ঠা চৌধুরী। বয়স এখন আশি ছাড়িয়েছে। তিনি একসময় অতিপ্রাকৃত গল্প লিখতেন, হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যান পঁচিশ বছর আগে।
যখন তারা তার কাছে যান, শর্মিষ্ঠা এক ঝলকে পেনটা দেখে আঁতকে উঠেন।
“এই পেনটা... এটা আমার হাতে ছিল এক সময়। আমি এটা দিয়ে লিখেছিলাম একটি উপন্যাস, যেখানে আমি চেয়েছিলাম আমার স্বামীর মৃত্যু। লেখাটা শেষ করার পর... সে সত্যি মারা যায়। আমি ওইদিনই পেনটা ছুঁড়ে ফেলে দিই গঙ্গায়। কিন্তু এটা তো আবার এসেছে!”
স্নেহাশিস এবার বুঝলেন, এই পেনটা আসলে এক অভিশপ্ত বস্তু। যার হাতেই পড়ে, তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এক রাতে, তিনি লিখে ফেললেন — “আমি আর এই পৃথিবীতে থাকবো না। আমি সব কিছু থেকে মুক্তি চাই।”
লিখেই তিনি চেতনা হারালেন।
সকালে চোখ মেলতেই দেখলেন, তিনি বেঁচে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে সুব্রত। চিরকুটে শুধুই লেখা —
"তুমি সাহসী, তাই তোমার মৃত্যু হয়নি। কিন্তু পেনটা এবার তোমার থেকে যাবে না।"
সেইদিন রাত থেকে স্নেহাশিস নিখোঁজ। পুলিশ তদন্ত করে পায় তার লেখার ঘরটা তালাবন্ধ। কিন্তু পেনটা নেই।
আজ আবার সেই বয়স্ক লোকটি হাঁটছেন। তার হাতে সেই সবুজ পেন।
সে ফিসফিস করে বলে
“সত্য যদি ভয় পায়, তবে মিথ্যাই জয়ী হয়। আমি আবার লিখবো — এই পৃথিবী বদলাবে।”
সে সবুজ পেনটা দিয়ে আবার লিখতে শুরু করল —
“মানুষ যখন সত্যের প্রতি সৎ থাকবে, তখন এই পেন থাকবে নীরব। আর যদি কেউ চায় নিজের ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীকে বাঁকাতে — তখন পেনটা রক্তের খোঁজ করবে।”
পেছনের ধোঁয়ায় ভেসে যায় তার চেহারা।
সবুজ পেন আবার প্রস্তুত — কারো সত্য লিখে দিতে।
........ সমাপ্ত........
প্রীতম মাইতি: ‘সবুজ পেন-এর রহস্য’ লেখাটির
লেখক প্রীতম মাইতি একজন উদীয়মান এবং প্রতিভাবান সাহিত্যস্রষ্টা, যিনি রহস্য ও থ্রিলার ঘরানার লেখায় বিশেষ পারদর্শী। তিনি ‘গোপাল খুড়োর ফাইলস’
নামক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের স্রষ্টা, যেখানে যুক্তি, আবেগ ও নাটকীয়তা মিলে তৈরি হয় এক অনন্য রহস্যজগত। বর্তমানে তিনি UGC-NET পরীক্ষার প্রস্তুতিতে
নিবেদিত, পাশাপাশি সাহিত্যের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই লেখালেখি
চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর লেখার মূল প্রেরণা
এসেছে বন্ধু গোপাল এবং তাঁর মা-র কাছ থেকে, যাঁদের ভালোবাসা, সাহচর্য ও উৎসাহ তাকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু সৃষ্টি করতে অনুপ্রাণিত করে। পাঠকের মন ছুঁয়ে যাওয়া অনুভব, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং রুদ্ধশ্বাস রহস্য নির্মাণই প্রীতম মাইতির লেখার
বৈশিষ্ট্য।