ব্যাকবেঞ্চার ~ শ্রেয়শ্রী কোলে কামল্যে

 



       
                    দিলীপবাবু বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ দেখলেন একটা বাইক এসে ওনার সামনে থামল। বাইকার হেলমেট খুলতেই চিনতে পারলেন রায়পুর হাইস্কুলের 2013-র মাধ্যমিক ব্যাচের ফার্স্ট বয় এবং দিলীপবাবুর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র শুভদীপ বসু। শুভদীপ বাইক থেকে না নেমেই জিজ্ঞাসা করল, "স্যার কেমন আছেন? কোথায় যাবেন?" দিলীপবাবু উত্তর দিলেন, " আমি ভালো আছি। আমি এই একটু বি. ডি. ও. অফিস যাবো। এপ্রিল মাসে অবসর নিলাম, তাই পেনশনের কিছু কাগজপত্রে সই করাতে হবে। তুই কেমন আছিস? তুই এখন কী করছিস?" "খুব ভালো আছি স্যার। মার্চ মাস থেকে আমি এই ব্লকে বি.ডি.ও হিসেবে যোগ দিয়েছি। আচ্ছা স্যার আসছি, এখন দাঁড়ানোর সময় নেই। আপনি আসুন, আমি সই করে দেব। কথাটা বলে শুভদীপ চলে গেল।

                    শুভদীপ চলে যাওয়ার পর প্রায় কুড়ি মিনিট কেটে গেল, কিন্তু কোনো গাড়ি এল না। আরও পাঁচ মিনিট পর আরো একটি বাইক এলো। এবার বাইক আরোহী বাইক থেকে নেমে হেলমেট খুললো। হেলমেট খুলেই দিলীপবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। দিলীপবাবু চিনতে পারলেন যে শুভদীপদের ব্যাচের একজন স্টুডেন্ট, নাম ঋতম। স্কুলে ঋতম পড়াশোনা করত না, সবসময় পিছনের দিকের বেঞ্চে বসত। কথায় আছে স্কুলশিক্ষকরা স্কুলের সবচেয়ে ভালো স্টুডেন্ট আর সবচেয়ে খারাপ স্টুডেন্টদের মনে রাখেন। পড়াশোনা ভালো করত না বলে দিলীপবাবু ঋতমকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। ঋতম বলল, "স্যার কেমন আছেন?" দিলীপবাবু বললেন, "আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? তা কাজকর্ম কিছু করছিস নাকি শুধু ঘুরেই বেড়াচ্ছিস?" "ঘুরে বেড়ানোর সময় আর কোথায়, স্যার? বছর দুয়েক হল বাবা মারা গেছেন। সংসারের খরচ, ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য কাজ তো করতেই হচ্ছে স্যার। তবে স্যার স্কুলে আপনার কথা শুনে যদি পড়াশোনাটা করতাম তাহলে হয়তো একটা সরকারি চাকরি করতাম। কিন্তু তা তো আর হলো না। তাই একটা ফাস্ট ফুডের দোকান খুলেছি। স্যার আপনি কোথায় যাবেন? চলুন আপনাকে দিয়ে আসি," বলল ঋতম। দিলীপবাবু বললেন, "না রে, তোকে এত ছটফট করতে হবে না। গাড়ি এলে, আমি চলে যাবো।'' ঋতম বলল, "এটা বললে তো হবে না স্যার। আপনার সঙ্গে আমার দেখা যখন হয়েছে, তখন আপনাকে নিয়ে গিয়ে আমি নামিয়ে দিয়ে এসেই দোকানে যাবো। আপনি বলুন কোথায় যাবেন?" দিলীপবাবু অগত্যা গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, "আমি বি.ডি.ও. অফিসে যাবো। কিছু সই করানোর আছে।" "তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই নেই। আমার দোকান বি.ডি.ও. অফিসের সামনেই। অফিসের লোকজনের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে, আপনাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হবে না,"  বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলল ঋতম।
                       
                     প্রায় দশমিনিট পর ওরা বিডিও অফিসের সামনে এসে থামলো। ঋতম একটা ফাস্টফুড ভ্যানের পাশে গাড়িটা রাখলো, বলল, ''স্যার আপনি এই গাছের ছায়ায় চেয়ারে একটু বসুন, আমি সঞ্জয়বাবুকে ফোন করে আপনার ডকুমেন্টসে সই করানোর ব্যবস্থা করছি। দিলীপবাবু চেয়ারে বসে দেখলেন ভ্যানটা বেশ বড়ো। ভ্যানের ওপরে লেখা ব‍্যাকবেঞ্চার ফাস্ট ফুড সেন্টার। লিস্ট এ অনেক রকম ফাস্ট ফুডের নাম লেখা আছে, দামও দেখলেন মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেই। ভ্যানে দুজন কর্মচারী রান্না করছে। লোকজনের ভিড় বেশ ভালোই। দুজন বারো তেরো বছরের ছেলে  কাস্টমারদের খাবার পরিবেশন করছে। মিনিট পাঁচেক পর ঋতম দিলীপবাবুর সামনে এসে বলল, "স্যার আসুন, আমি কথা বলে নিয়েছি, আপনি গেলেই সই হয়ে যাবে। অপেক্ষা করতে হবে না। এই রবি দোকানটা একটু দ্যাখ, আমি স্যারকে সঞ্জয়বাবুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়ে আসছি।" দিলীপবাবু বললেন, "দোকানে ছোট ছেলেদের দিয়ে কাজ করাছিস কেন?" "আরে না না স্যার! ওরা আমার খুড়তুতো ভাই। এখন গরমের ছুটি পড়েছে। বাড়িতে খুব জ্বালাতন করে, ফোন নিয়ে বসে থাকে বলে আমার কাকিমারা আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।"
                            
                          ঋতম দিলীপবাবুকে নিয়ে গিয়ে একজন বছর পঁয়তাল্লিশের ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়ে দোকানে ফিরে এল। ভদ্রলোক বললেন, "আসুন স্যার, আমার নামই সঞ্জয়। আপনার ডকুমেন্টস দিন।" দিলীপবাবু ডকুমেন্টস  বের করে সঞ্জয়বাবুর হাতে দিয়ে কোথায় কোথায় সই করতে হবে দেখিয়ে দিলেন। সঞ্জয়বাবু একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, "আপনি এখানে বসুন, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।" দিলীপ-বাবুকে বসিয়ে সঞ্জয়বাবু চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর শুভদীপ অর্থাৎ বি.ডি.ও এসে বলল, "ও! স্যার আপনি এসে গেছেন। ঠিক আছে বাইরে অপেক্ষা করুন, সময় হলে আমি লোক পাঠিয়ে আপনাকে  ডেকে নেব।' বাইরে যেতে যেতে দিলীপবাবু দেখলেন, "শুভদীপ একজন বছর ষাটেকের ভদ্রলোকের ওপর খুব চেঁচামেচি করছে। সম্ভবত উনি গ্রুপ ডি কর্মচারী। বি.ডি.ও. সাহেবের ঘরে জল রাখা হয়নি বলে শুভদীপ চিৎকার করছে। দিলীপবাবু বাইরের বেঞ্চে বসলেন। প্রায় দশ মিনিট পর সঞ্জয়বাবু এসে হাতে ডকুমেন্টস দিয়ে বলল, " এ কী আপনি এখানে? আমি আপনাকে ভিতরে চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।" "বি.ডি.ও সাহেব আমাকে এখানে বসতে বললেন," দিলীপবাবু বললেন। সঞ্জয়বাবু বললেন, "ও আচ্ছা! আপনার সব ডকুমেন্টসে সই হয়ে গেছে।" দিলীপবাবু সঞ্জয়বাবুকে ধন্যবাদ ও বিদায় জানিয়ে নীচে নেমে এলেন।

                         দিলীপবাবু ঋতমের দোকানের সামনে এসে দেখলেন দোকানে খুব ভিড় হয়ে গেছে। তাই উনি কিছু না বলে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করে বামদিক থেকে "স্যার!" কানে আসতেই থমকে গেলেন। ঋতম কাছে এসে বলল, "আপনার কাজ হয়েছে স্যার?" "হ্যাঁ হয়ে গেছে। অসংখ্য ধন্যবাদ রে তোকে, আমার অনেক আশীর্বাদ রইল," দিলীপবাবু ঋতমের মাথায় হাত রাখলেন। ঋতম বলল, "স্যার চলুন আমার ছোট্ট দোকানে একপ্লেট মোমো খাবেন। তারপর আমি আপনাকে বাইকে করে পৌঁছে দিয়ে আসবো।" "আমি তো অত টাকা সঙ্গে নিয়ে আসিনি, রে," বললেন দিলীপবাবু। ঋতম জিভ কেটে বলল, " ছি ছি স্যার, আমি আপনার থেকে টাকা নিলে ভগবান আমায় পাপ দেবে তো।"   ঋতম দিলীপবাবুকে জোর করে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে এক প্লেট মোমো দিল। খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর ঋতম দিলীপবাবুকে বাইকে চাপিয়ে নিয়ে গিয়ে দিলীপবাবুর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল। অনেকবার করে বাড়ির যেতে বলতেও ঋতম বাড়ির ভিতরে গেল না। দিলীপবাবু বললেন, "বিয়ে থা করেছিস?" "স্যার আমাকে আর কে বিয়ে করবে? আমার শরীরে যে সরকারি চাকুরিজীবির স্ট্যাম্প লাগানো নেই। এখন ভাবছি আপনার কথা শুনে যদি পড়াশোনাটা করে একটা  চাকরি পেতাম তাহলে বিয়েটাও এতদিনে হয়ে যেত।” কথাটা বলে আরো একবার স্যারকে প্রণাম করে বিদায় জানিয়ে ঋতম চলে গেল। দিলীপবাবু মনে মনে বললেন, শুধু সরকারি চাকরি নয়, মাঝে মাঝে ভালো মানুষের স্ট্যাম্প থাকাটাও জরুরি।