আলাহিয়া বিলাবল ~ বিজুরিকা চক্রবর্তী

 





জানালার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বসেছিলেন চিরন্তনী, অর্থাৎ 'একতান' নামক এন.জি.ও'র অন্যতম সদস্যা, একজন উৎকৃষ্ট গৃহিণী এবং সফল জননী শ্রীমতী চিরন্তনী বন্দ্যোপাধ্যায়। কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি, পাড়া-প্রতিবেশী থেকে আত্মীয়-স্বজন সকলের মনেই নিজের অভিজাত রুচি এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে এক আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। তাই সেই সকল গুটিকতক মানুষ যাঁদের নাম শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে আসে তাঁদের মধ্যে তিনি অনন্যা।

আজ সকাল থেকেই অনবরত বৃষ্টি পড়ে চলেছে। এন.জি.ও'র অফিস-ঘরের বাইরে শিশু গাছটার পাতাগুলো জলে ভিজে আজ যেন আরো বেশি করে সবুজ দেখাচ্ছে। এই একটানা বৃষ্টি, মাটির সোঁদা গন্ধ আর মেঘলা পরিবেশের একত্রিত সংমিশ্রণ জানলা দিয়ে উপভোগ করতে গিয়ে ব্যক্তিত্বময়ী চিরন্তনীর মনের মাঝে জমে থাকা স্মৃতিগুলোও যেন আজ আরও বেশি করে সবুজ হয়ে উঠছে। মনে পড়ে যাচ্ছে নবারুণ-এর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটা। সেদিন ছিল তাঁর দাদার অফিসের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। প্রথমে তিনি যাবেন না ঠিক করলেও দাদার অনুরোধ এবং উৎসাহ কোনোটাই অগ্রাহ্য করতে পারেননি চিরন্তনী। তাই ঠিক সন্ধ্যা ছটায় মা ও দিদির সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিলেন রবীন্দ্র সদন-এর মূল মঞ্চে। দাদার সুবাদে প্রথম সারিতেই বসেছিলেন ওঁরা। আসলে তাঁর দাদা অফিসের সি.ই.ও হওয়ার সুবাদে চিরন্তনীর পরিবার চিরকালই পেয়ে এসেছে এক আলাদা প্রাধান্য। আকাশী রঙের জামদানি শাড়ি, মাথায় জুঁই ফুলের মালায় সেদিন চিরন্তনী কে অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছিল। তাঁর দাদা আবিরলালের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠান হয়ে উঠল জমজমাট। একে একে সকল শিল্পীর সাথে পরিচিত হতে লাগলেন দর্শকেরা এবং উৎকৃষ্ট সুপরিকল্পিত অনুষ্ঠান গড়ে তুলল এক আকর্ষণীয় ও সমৃদ্ধ পরিবেশ। এরই মধ্যে ঘোষণা হল পরবর্তী শিল্পীর নাম, যিনি নাকি মাত্র কিছু মাস হলো যোগ দিয়েছেন এই অফিসে, কিন্তু এরই মধ্যে নিজের কর্মক্ষমতা ও অসাধারণ গুণে সকলের কাছে হয়ে উঠেছেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর সেরকমই এক অন্যতম গুণ তিনি তুলে ধরবেন আজ সকলের সামনে। তাঁর নাম শ্রী নবারুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে উঠলেন শিল্পী। সুন্দর, সুঠাম, সৌম্য চেহারার যুবকটির বিনম্র প্রণাম ও রুচিশীল সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচয় আর কাউকে ছুঁতে পারল কিনা ঠিক জানা নেই, তবে আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্বময়ী রমণীটির মনকে যে বেশ ভালোভাবেই নাড়া দিয়ে গেল তার প্রমাণ অবশ্য পরবর্তীকালে আমরা পাই। যুবকটির সুমধুর বাঁশি এক অদ্ভুত মোহময় পরিবেশে আচ্ছন্ন করে তুললো চারিদিক। একে একে ইমন, খাম্বাজ, কাফি- কি অপূর্ব পরিবেশনা! কি অসাধারণ সুর-মূর্ছনা! এ যেন স্বর্গের সুর। সময় সীমিত, আরো শিল্পীরা রয়েছেন- তাই এবারে মঞ্চে উপনীত শিল্পীর অন্তিম পরিবেশনা। বাঁশিতে বেজে উঠল আলাহিয়া বিলাবল-এর সুর; ‘সরে, গরে, গপ, ধ, নিধ নিস; সনি ধ, প, ধনি ধপ মগ মরে সা।‘ বাঁশিতে বন্দিশে উভয় নিষাদের বিশুদ্ধভাবে প্রয়োগ, শান্ত গম্ভীর স্বরবিন্যাস, বক্র ঋষভ ও যুগল গান্ধারের পরিমিত ব্যবহার এই উপস্থাপনাকে যেন শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা তুলে দিলো। চারিদিক ফেটে পড়ল হাততালিতে। আর একইসঙ্গে চিরন্তনীর মনেও বেজে উঠল শত তন্ত্রী বীণায় তোলা ঝড়- 'আলাহিয়া বিলাবল'। এরপর গ্রীনরুমে আলাপ ও তারপর টানা দু'বছরের প্রেমের পরে বিবাহ। আজও যেন সবকিছু একেবারে টাটকা। 

নবারুণ-চিরন্তনীর একমাত্র ছেলে নব্যেন্দু। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা খেলাধুলা সবেতেই পারদর্শী। চিরন্তনী নিজের মনের মতো করে মানুষ করেছেন তাকে। তার পরিচিত জগতে নব্যেন্দু অত্যন্ত রুচিশীল, ভদ্র ছেলে হিসেবেই খ্যাত। আই.সি.এস.ই- তে ৯৪ শতাংশ এবং আই.এস.সি-তে ৯৬ শতাংশ নম্বর পেয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পাস করে, নব্যেন্দু প্রথমে আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক এবং পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে  মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়। এরপর সাহা ইনস্টিটিউট থেকে পি.এইচ.ডি করার পর নব্যেন্দু ইউ.এস.এ-তে পোস্ট ডক্টরেট-এ চান্স পেয়ে জয়েন করে টেক্সাস ইউনিভার্সিটি। সেখানেই তার আলাপ রুমেলার সঙ্গে। সেও ভারতীয় এবং কলকাতার মেয়ে। কিছুদিন মেলামেশার পর দুজনের বিয়ে। রুমেলার বাড়ি থেকেই প্রথম প্রস্তাব আসে। তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। তবে চিরন্তনীর একটাই দুঃখ, তার ছেলের ঘরে কোন সন্তান হয়নি, আসলে ভগবান হয়তো সব সুখ সবার কপালে পুরোটা লিখে দেননা। অনেক স্বপ্ন ছিল চিরন্তনীর, নাতি-নাতনী যাই হোক তাকে তিনি সবসময় কাছে না পেলেও- তাঁর বংশজের মাধ্যমে নিজের সাধ ঠিক পূর্ণ করবেন। নব্যেন্দু কে দিয়ে একটিমাত্র আশা যা তিনি পূরণ করতে পারেননি- তা নব্যেন্দুর অংশ অর্থাৎ তাঁর পরিবারের রক্ত ঠিক মেটাবে,- আর সেই সাধ হলো 'বাঁশি'। নব্যেন্দু আর যাই করুক তার বাবার সুর সে কোনোভাবেই আয়ত্ত করতে পারেনি। আসলে পড়াশোনা, খেলাধুলা সব বিষয়ে আগ্রহ থাকলেও প্রাচ্য সুরের প্রতি কোনদিনই টান ছিল না তার। আর সেইখানেই চিরন্তনীর এক বিশাল শূন্যতা। তাই তিনি নব্যেন্দুর সন্তানকে দিয়ে তাঁর এই অপূর্ণ সাধ পূরণ করতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। কিন্তু বিধাতার নিষ্ঠুর লীলা। অনেক ডাক্তার বদ্যি করেও কোন সুফল না পাওয়ায়, অবশেষে নব্যেন্দু-রুমেলা উভয়ই পারস্পরিক আলোচনা করে, অনেক সরকারি আইন কানুন মেনে, কলকাতারই এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে দত্তক নিল এক শিশু কন্যাকে, যার বয়স ছিল তখন দুই মাস। প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও পরে চিরন্তনী আর বাধা দেননি। কারণ এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ তাঁর ছেলে-বউয়ের ব্যক্তিগত। নবারুণের অবশ্য কোনদিনই আপত্তি ছিল না। আসলে চিরন্তনীর মধ্যে একটা গোঁড়া ধারণা চিরকালই বিরাজমান, আর তা হল - 'জিন কথা বলে'। কে জানে এই বাচ্চার বায়োলজিক্যাল বাবা মা কেমন ছিল!! এই বাচ্চা ওরা যতই মানুষ করুক এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। এ পুরোপুরি কখনোই তাদের মতো হতে পারে না। সে যাই হোক, ভেবে মন খারাপ করে লাভ নেই। ছেলে বউ খুশি থাকলেই শান্তি। এরপর কেটে গেল অনেকগুলো দিন।

নব্যেন্দু-রুমেলার মেয়ে 'রিনি' এখন তেরো বছরের কিশোরী, ইউ.এস.এ-তেই আছে ওরা। মাঝে অবশ্য বার কয়েক দেশে ঘুরে গেছে। একবার, রিনির তখন চার বছর বয়স, দ্বিতীয়বার ওর স্কুল চেঞ্জ করার আগে রিনির তখন আট, আর তৃতীয়বার অর্থাৎ দু'বছর আগে নবারুণ যখন সিভিয়ার হার্ট-অ্যাটাক্-এ চলে গেল। সেবার অবশ্য রিনি আসতে পারেনি ওর পরীক্ষার কারণে, পাশেরই ওদের এক প্রতিবেশীর কাছে ছিল ওই দেশে। এরপর এই দু'বছর চিরন্তনী ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। তবে ফ্ল্যাটের সকলেই খুব আন্তরিক, এছাড়া কর্মক্ষেত্রে বিশাল সময় কাটানোর সুবাদে একাকীত্ব বোধ তাঁকে খুব একটা গ্রাস করতে পারেনি।

যাই হোক, আজ হঠাৎ এই বৃষ্টির দিনে সবকিছু আবার ছবির মতো ভেসে উঠছিল তাঁর চোখের সামনে। এইবার তাঁকে সব গুছিয়ে বেরোতে হবে। আজ তিনি একটু তাড়াতাড়িই বেরোবেন এন.জি.ও থেকে। আসলে এই সবে গতকাল ছেলে-বৌ আর তাদের মেয়ে ইউ.এস.এ থেকে এসেছে, হঠাৎ সারপ্রাইজ ভিজিট। তাই আজ যা কিছু অফিশিয়াল কাজকর্ম ছিল তা অনেক আগেই সেরে নিয়েছেন চিরন্তনী। বাচ্চা মেয়েটা আসার আগে বারবার বলে দিয়েছে, "গ্র্যানি প্লিজ কাম ব্যাক সুন, আই ওয়ান্ট টু স্পেন্ড টাইম উইথ ইউ!" ইস্ এসেই কি বিশ্রী আবহাওয়ায় পড়েছে ওরা। চিরন্তনীর যতই ভালো লাগুক ওদের কাছে নিশ্চয়ই এই আবহাওয়া খুবই আনওয়েলকামিং। যাই হোক ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে পিওনকে ডেকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। এখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। একটা বাসে করে সোজা সিঁথির মোড় আর সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে সোজা ফ্ল্যাট। চাবি দিয়ে কলাপসিবল গেটের তালা খুলে উঠে পড়লেন লিফটে। কিন্তু তিন তলায় উঠে কলিংবেল বাজাতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে সুন্দর মিষ্টি বাঁশির সুর.. এ সুর তাঁর খুব চেনা, খুবই আপন- 'আলাহিয়া বিলাবল'। কিন্তু কে বাজাচ্ছে বাঁশি? চিরন্তনী চঞ্চল হয়ে ডোরবেল বাজিয়ে দিলেন। ভিতর থেকে সারা নিয়ে রুমেলা দরজা খুলে দিয়ে হেসে বলল, "এসো মম্।" চিরন্তনী তখন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে খুঁজে চলেছেন সেই সুরের উৎস। অন্য কোন দিকে লক্ষ্য করার তাঁর আজ সময় নেই। এক বহু কাঙ্খিত অমূল্য ধন এর হদিস যেন অবশেষে মিলতে চলেছে আজ। একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তাঁর উৎসুক চোখ যখন খুঁজে চলেছে সেই স্বর্গীয় সুরের সূত্র, ঠিক তখনই তাঁর চোখে পড়ল হালকা ভেজানো বাঁদিকের ঘরের পাল্লাটা। যদিও তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ, তবুও আজ নক্ না করেই চিরন্তনী খুলে ফেললেন সেটা। আর স্তম্ভিত হয়ে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন। ভিতরে খাটের উপর চোখ বন্ধ করে বসে আছে নব্যেন্দু আর ছোট্ট রিনি একনাগারে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি। তার ছোট ছোট আঙ্গুলগুলো খেলে চলেছে বাঁশির উপর আর ঠোঁট সুর তুলছে 'সরে গরে গপ ধ.. ' এক মনে বাজিয়ে যাচ্ছে একরত্তি মেয়েটা। রুমেলার ডাকে নব্যেন্দু চোখ খুললো। মাকে দেখে হেসে বলল, "আসলে রিনিকে আমি আমাদের ওখানেই ফ্লুট ক্লাসে ভর্তি করিয়েছি। জানো মা পুরো বাঙালি পরিবেশ। যিনি শেখান সেই ভদ্রলোকও বাঙালি। আমিতো জানি তোমার মনের ইচ্ছার কথা। আমায় দিয়ে তো আর হলো না। ও কিন্তু ভালো কোপা আপ করছে। তবে সবে শিখছে তো, দেখবে ধীরে ধীরে আরো ভালো করবে। কি গো মা কিছু বলছো না যে? ভালো লাগেনি?!" চিরন্তনীর গলার কাছটায় কিরকম দলা পাকিয়ে উঠছে, দুচোখের পাতা ভিজে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তবে এ অশ্রু আনন্দের। ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে গেলেন রিনির কাছে, বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট স্বরে শুধু বললেন, "এই না হলে আমার নাতনি!"





ড. বিজুরিকা চক্রবর্তী, কলকাতা দমদমের, বাসিন্দা। সেন্ট জেভিয়ার'স কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্ৰী পাওয়ার পর বর্তমানে এন.আর.এস মেডিক্যাল কলেজের এম.আর.ইউ ডিপার্টমেন্টে রিসার্চ-সায়েন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া এক জেদী, একরোখা, অবিচ্ছেদ্য বন্ধু, যে বন্ধু এখনো অবধি কখনো বেইমানি করেনি। ইতিমধ্যে বহু পত্র-পত্রিকা, ওয়়েবসাইট, সংবাদ পত্রে লেখা প্রকাশিত। বহু সম্মাননা প্রাপ্ত। প্রথম একক কাব্য সংকলন 'কে তুমি?' আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা ২০২৪ এ প্রকাশিত হয়।