গৌরাঙ্গপ্রিয়া ~ তাপস রায়

 





মালতী সকাল বেলায় প্রায় ঘুম চোখেই দুধ দোয়াচ্ছিল নন্দরানীর। দুধ ঘড়া উপচে যে পড়তে লেগেছে সে খেয়াল নেই। সে নন্দরানীর দুটো পুরু বাট দুই হাতে পালা করে টেনে যাচ্ছে। দুধ হবার যেমন বিরাম নেই, তেমনি মালতীও গৌরাঙ্গের সঙ্গসুখ ভাবনায় অনবরত নিজেকে মথিত করে চলেছে। থেকে থেকে তার সারা শরীর কেঁপে উঠছে। ওই সোনার বরণ নওল কিশোর মূর্তির পুরুষটি যে তাকে অধিকার করে নিয়েছে। সোনায় বাঁধান হাত দু’টির মালিক যে একদিন এই মালতীলতাটিকে তার নিজের বুকের ভেতরে তুলে নিয়েছিল।

নন্দরানী নামে গাইটি অবাক হয়েছে খানিক। সে নিজের ইচ্ছেয় মালতীর দুধের ঘড়া পূর্ণ করে দেয় রোজ। কিন্তু আজ কী হলো! মালতী যে তাকে দুয়েই চলেছে। শেষ হচ্ছে না যেন। নন্দরানী গাইটি খুব শান্ত আর মালতীর অনুরাগী। সে কখনও পা টা ছোঁড়ে না। সেসব করলে মালতীর গায়ে আঘাত লাগতে পারে। মালতী ব্যথা পেতে পারে। বরং সে নিজে খানিক ব্যথা লাগলেও সয়ে নেয়। কেন যেন এই নন্দরানীর মালতীর হাতের ছোঁয়া পেতে ভালো লাগে। তার মাখনের মতো নরম হাত যখন নিজের বাটের উপর পড়ে তখন রোজই নন্দরানীর শরীরে শিহরন লাগে। সে তার দুধের ভান্ডার মেলে দেয় মালতী গোয়ালিনীর হাতে। দুধের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেলে মালতী উঠে এসে গলায় হাত বুলোয়, মাথায় হাত বুলোয়। সেটাও যে অনেকখানি পাওয়া।

নন্দরানী পেছনে মাথা বাঁকিয়ে লক্ষ্য করেছে দুধ ঘড়া উপচে পড়ে যাচ্ছে আর মালতী অন্য কোন দিকে তাকিয়ে দুধের বাট টেনে চলেছে। নন্দরানী চায় কিছু একটা করে তাকে থামাতে। সে দু’বার হাম্বা করে ডাক দিল।

নন্দরাণীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে মালতী লজ্জায় মরে যায়। দুধ তার উবু হয়ে বসা দুই পায়ের ফাঁকে ধরা ঘড়া উপচে শাড়ি ভিজিয়ে দিয়েছে। দুধের গাঁজলা তার হলুদ কাঁচুলির উপর সাদা ফুল হয়ে ফুটে আছে।

মালতী জিভ কেটে ঝপ্‌ করে উঠে দাঁড়ায়। কোমরে দুধের ঘড়া নিয়ে এক হাতে বুকের উপর থেকে দুধের ফেনা মুছে ফেলতে লাগল। নাহলে এই অনাছিস্টি দেখে মা বকবে। দুধের ফেনার দাগ মুছে মালতী নন্দরানীর মুখের কাছে এসে তার গলায় আদর করতে করতে বলল, “ খুব অন্যায় হয়ে গেছে রে নন্দরানী। আর হবে না। আমি যে গৌরাঙ্গ স্মৃতিতে মজে ছিলাম। তোর কথা মনে ছিল না। রাগ করিস না।”

নন্দরানীকে না বলে কাকে আর মনের কথা বলবে মালতী! গৌরাঙ্গ অভিসারের প্রথম দিনের সাক্ষী তো এই নন্দরানীই। নন্দরানীকে মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাবার অছিলায় নদীর পারের পুবের মাঠে দেখা করেছিল মালতী গৌরাঙ্গের সাথে। বুড়ো তমাল গাছের গোড়ায় বসেছিল। নন্দরানী মাঠে ঘাস খেতে খেতে চোখ তুলে সব দেখেছে। নন্দরানী সব জানে।

কথা ততটা না বুঝলেও মালতীর আদরটুকু নিয়ে মাথা দুলিয়ে তার খুশি জানাতে ভুলল না নন্দরাণী। মালতী খুশিতে ডগমগ অনেক দিনই। যেদিন প্রথম এই বাড়িতে ওই পণ্ডিত ছেলে ঢুকেছিল, সেদিন থেকে। ওরে বাপরে বাপ, যেমন চোখ ধাঁধানো চেহারা, তেমনি তার মুখের তোড়ে সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না। শান্তিপুরের শাস্ত্র সম্রাট অদ্বৈত আচার্যকে নাকি খড়-কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়েছে্ন। বাড়িতে টোল খুলেছেন তিনি। মালতী আরো শুনেছে এই সুন্দর পুরুষ শুধু কথায় নয়, মারামারিতেও দড়। তার মুষ্ঠাঘাতে নাকি নবদ্বীপের কয়েকজন অসাধু মানুষের মুখ ভেঙেছে।

মালতী দুধের ঘড়া নামিয়ে রেখে মা-র কাছ থেকে গামছা চেয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে যায় পদ্মপুকুরের দিকে। আজ গাই দোয়াতে সময় খানিক বেশি নিয়েছে। দোয়ানোর আগেও অনেকক্ষণ কথা কয়েছে প্রিয় গাইটির সাথে। ফলে রুটিন কাজে দেরি হয়ে গেছে পরপর। স্নানের পর নিজেদের ফুলের বাগান থেকে ফুল তুলে সেই ফুলে গৃহদেবতা গোপীনাথের অর্চনা। তারপর বাবা দুধ বেচে ফিরে এলে তাকে খাবার দেয়া। দাদা অদ্বৈত আচার্যের টোলে পড়তে যাবে, তাকে খাইয়ে পাঠানো। বাগাল ছেলে থাকলেও মাঝে একবার গোয়াল ঘরে গিয়ে দেখে আসতে হয় তাদের আঠারোটি গাই আর ছ’টি বাছুরের খাওয়াদাওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা। গোয়াল পরিস্কার আছে কিনা। মালতী একদম দম ফেলতে পারে না। সেই কিশোরী বয়সেই রুগ্না মায়ের হাত থেকে এই সব দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে মালতী।

এই রুটিন বাঁধা জীবনে তার নিজের বলতে ওই গৌরাঙ্গ দর্শন। সেও কি রোজ হয় নাকি! কিন্তু তাকে তো তৈরি থাকতে হয়। কখন যে সেই সোনার মূর্তি এসে হাজির হয়ে যাবে! প্রথম দিন দাদার সাথে একগাদা চ্যাংড়া ছেলেদের নিয়ে খোল বাজিয়ে হরি নাম করতে করতে এ বাড়িতে ঢুকেছিল। তখন কত আর বয়স মালতীর—ষোলো, সতেরো হবে। দরজার কপাটে এক হাত রেখে মালতী ওই সোনারবরণ শাল তরুর মতো চেহারার ছেলেকে তাদের উঠোনে তুলসী মণ্ডপ ঘিরে নাচে,গানে, বাজনায় মাতিয়ে দিতে দেখে মোহিত হয়ে তাকিয়ে ছিল। একবার চোখে চোখ পড়তেই মালতীর গোটা শরীরে ঝাঁকুনি। এ কে! গৌরবরণ সেই ছেলে নিমাই পণ্ডিতও গান থামিয়ে দিয়েছে তখন। তার চোখেও কী এক আকুলতার জন্ম হলো যেন।

পদ্মপুকুরের ঘাটে বসে মালতী নিজের পিত্তলবর্ণ পা থেকে ঘষে ঘষে ভেজা গামছা দিয়ে ময়লা তুলতে তুলতে এসব কথা মনে করে হেসে খুন হয়ে যাচ্ছিল। একটা ফিঙে পাখি তার সামনের খেজুর কাঠের গুঁড়ির উপর বসে মাথা ঝুঁকিয়ে জল অল্প অল্প গায়ে লাগিয়ে পিক্‌ পিক্‌ শব্দ তুলে লেজ নাচাচ্ছে। পিট্‌ পিট্‌ করে তার দিকে তাকাচ্ছেও। মালতীকে মোটেও ভয় পাচ্ছে না। মালতী জানে তাকে কেউই ভয় কেন, গেরাহ্যির ভেতর রাখে না। শুধু ওই গৌরাঙ্গসুন্দর ছাড়া তাকে কেউ তেমন করে চেয়েও দেখে না।

মালতী ফিঙে পাখিকে বলল, “ যা, তোর চান হয়ে গেছে, এবার আমায় করতে দে। আমার যে কত কাজ! সেসব শেষ করে আবার তার জন্য বিকেল বিকেল গা ধুয়ে নতুন কাপড় পরে বুক বেঁধে পুবের মাঠের দিকে যেতে হয়। যদি সে আসে! সন্ধ্যার আগেই আবার বাড়িতে ফিরে তুলসী তলায় প্রদীপ দেয়া। আমার কি কম কাজ! সর সর।”

বলতে বলতে মালতী ফিঙের পাশ দিয়েই জলের বুকে নেমে গেল। প্রায় দিঘির মতো পুকুর। তার বাবা নবীন গোয়ালা এই জলাভূমি সহ জঙ্গল পরিস্কার করে গোশালা বসিয়েছিল। এটা লোকালয় থেকে একটু দূরে। তার খারাপ লাগেনি জায়গাটা। গরুর পরিচর্যা করতে জল আর বন দুটোই দরকার। দুটো একসাথে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। তিনি বলেন, সব গোপীনাথের ইচ্ছে। গোপীনাথ তাঁকে যা নির্দেশ করেন, তাই তিনি করেন। আর তাতে তাঁর ভালোই হয়েছে।

পুকুরের চারদিকে আম আর কদম্ব গাছের ঘন পল্লবিত পাতায় এমনি এমনিই একটা আড়াল হয়েছে। নিজেদের সীমানার ভেতর বলে সেখানে বাইরের কেউ আসেও না। মালতী বুক জলে দাঁড়িয়ে একটা ডুব মেরে উঠে বুকের বাঁধন আলগা করে কাপড়ের টুকরোটিকে হাতে নিয়ে জলে চুবিয়ে ঘষে ঘষে দুধের দাগ তুলল। তারপর সেই কাপড়ে নিজের বুক ঘষতে গিয়ে দেখল ভারী সুন্দর লাগছে আধোডোবা ফুটে উঠতে চাওয়া পদ্মফুল দু’টি। কেমন মায়া লাগল কঠিন কাপড় দিয়ে তাদের ঘষতে। মালতীর মনে হলো সে দুটি কাপড়ের বাঁধন মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা পেয়ে কেমন খিলখিল করে হাসতে লেগেছে। মালতী তার কোমল আঙুল দিয়ে তাদের খানিক মমতা দিল। আর একটু বাদে টের পেল তার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা একটা বড় শ্বাস পুকুরের অল্প আলোড়িত জলে নেমে সাঁতার কাটতে লেগেছে যেন। জলে ঢেউ উঠছে।


ভারী মিষ্টি গলা মালতীর। কণ্ঠ ঢেউ মেলেছে চণ্ডীদাসের পদে।। গোপীনাথের অঙ্গ চন্দন আর তুলসিতে চর্চিত করতে করতে মালতী কণ্ঠে নিয়েছে পদঃ

“পিরিতি পিরিতি কী রীতি মূরতি

হৃদয়ে লাগল সে।

পরাণ ছাড়িলে পিরিতি না ছাড়ে

পিরিতি ধরাল কে?”

খালি গলায় উদাস করে দেওয়া সুর হাওয়ায় ছড়িয়ে দেয় মালতী। সে নিজের গান আর গোপীনাথের অর্চনার কাজের ভেতর ডুবে থাকে । এটা রোজকার কাজ। কিন্তু সেদিন হঠাৎ গান করতে করতে টের পেল, তিম্‌ তিম্‌ তিম্‌ তিম্‌ করে কেউ যেন খোলে দশকুশি বাজাচ্ছে। আর মালতীকেও তার সুর সেই তালের সঙ্গে বড় করতে হচ্ছে। শুনতেও অন্য রকম ভালো লাগছে তা। মালতী দুবার গাইল এই পদ।

সে নিজের মনেই বলল, আহা! তারপর চকিতে মৃদঙ্গের বাজনা অনুসরণ করতে গিয়ে তো থ। তার গান থেমে গেছে। গোপীনাথের মন্দিরের সিঁড়িতে বসে লম্বা বাবরি চুল দুলিয়ে সোনার বরণ সেই ছেলেই যে খোল বাজাচ্ছে! মালতী একদিনই দেখেছে গৌরাঙ্গ যেমন নাচে, তেমনি গায়, আর মৃদঙ্গের হাতটিও তুখড়। কিন্তু সেদিন তো অনেকের সাথে এসে তাদের মন্দির প্রাঙ্গনে খোলের বাজনার সাথে নামগান আর নৃত্য করেছিল। আজ তারা কোথায়! মালতী কাউকেই খুঁজে পায় না। শুধু দেখে মাথা নিচু করে একমনে বাজিয়ে চলেছে তার পিরিতি মূরতি।

মালতী গৌরাঙ্গকে চোখের সামনে দেখে এমন আকুল আকুল হয়ে গেল ! সে যে গান নিবেদন করছিল, তা গোপীনাথকে না গৌরাঙ্গকে এসময় বিচার করতে পারছে না। সেদিন গৌরাঙ্গকে দেখার পর থেকেই যে মালতী অন্য হয়েছে, তা সে নিজে জানে। মালতীর দু’চোখ ঝাপসা হয়ে এল। গোপীনাথের তিন ফুটের কাঠের মূর্তির দিকে তাকিয়ে সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। উল্টো দিকে ঘুরে তাকাল। সিঁড়িতে বসা গৌরাঙ্গমূর্তিও দেখতে পাচ্ছে না। মালতী ভয় পেয়ে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘গোপীনাথ’!

মূর্ছা ভাঙ্গার পর মালতী দেখল দুটো পদ্মকান্তি চোখ তার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। তার মাথা কোলে করে নিয়েছে সেই অনিন্দ্যসুন্দর চোখের মালিক।

“ এখন একটু ভালো লাগছে?”

মালতীর মুখ থেকে কথা সরে না। সে যেন মেঘের মতো ভাসছে এক সোনারোদে রাঙানো আকাশে। মালতী চোখ বুজে বুঝে উঠতে চায় সত্যিটি। যে ছেলের দেখা পাবার জন্য আকুল হয়ে চন্ডীদাসের পদ কণ্ঠে নিয়েছিল, তার কোলেই সে শুয়ে আছে! এটা সম্ভব! তার একরাশ কাঁধ ছাপানো চুলের দু-এক গুচ্ছ মালতীর মুখের উপর এসে পড়েছে বলেই হয়ত মালতী দ্রুত নিজত্বে ফিরতে পেরে ঝপ করে কোলের উপর থেকে উঠে বসে। পরনের শাড়ি টেনেটুনে নিজেকে ভালো করে আবৃত করে। তারপর মাথা নিচু করে বলে, “ আমাকে মার্জনা করবেন। আমার মাথা কেন ঘুরে গেছিল জানি না। আমার চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছিল। প্রভু গোপীনাথকে আমি দেখতে পারছিলাম না বলে অমন চিৎকার করেছিলাম।”

গৌরাঙ্গ গোপীনাথের মন্দির থেকে নেমে যেতে চেয়ে শুধু বলল, “ এদিকে এসেছিলাম। তোমার দাদাকে নিয়ে, আর আরো সব গোয়ালাদের নিয়ে যে আজ নবদ্বীপের পথে নামসংকীর্তনে বের হব অপরাহ্নে। এখান থেকে যাব তাঁতিপাড়া, চণ্ডালপাড়া, জেলেপাড়া, কুম্ভকারপাড়া -য়। সবাইকে নিয়ে নবদ্বীপের পথে পথে আট প্রহর আমরা হরি নাম বিলিয়ে নাচ-গান করব। আমি তোমার দাদাকে নিতে এসেছিলাম।”


মালতীর মুখে এবার কথা ফুটেছে। তার ইচ্ছে করছে না প্রাণাধিক এই দিব্য পুরুষ এখনই চলে যান। কথার পাকে যতখানি আটকে রাখা যায়, ততটা লাভ। চোখের ভেতর দিয়ে একেবারে হৃদয়পুরীতে বসিয়ে নিতে হবে এই জীবন্ত বিগ্রহ।

মালতী বলল, “ দাদা তো এখনও ফেরেনি। সে ভোরে বেরিয়েছে। অদ্বৈতের টোলের পাঠ সেরে ফিরতে ফিরতে আরো এট্টুস দেরি হবে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন প্রভু, আপনার তাল বাদ্য যদি আর একটু শোনান। সে বাজনা আমার খুব ভালো লেগেছে।”

গৌরাঙ্গ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “ মৃদঙ্গ বাদন ভালো লেগেছে? বেশ বেশ। আবার বাজাতে আমি পারি, কিন্তু সেজন্য তো গান গাইতে হবে সুভদ্রে। গান গাইলে তার সাথে আমি বাজাতে পারি ।”

মালতী এই সর্বগুণে গুণান্বিত দিব্য পুরুষের সামনে জেনে বুঝে আবার গান করতে কি পারবে! তার গলা শুকিয়ে আসছে যেন! বুক কাঁপছে, পা-ও কাঁপছে। সে ঝপ্‌ করে বসে পড়ল মেঝেতে। পারবে না বলতেও চাইছে না। তাহলে যে গৌরাঙ্গসুন্দর চলে যাবে চোখের সামনে থেকে। অন্যদিকে জিভের উপর কেউ যেন সাত মন পাথর চাপিয়ে রেখেছে। মালতি দেখল গৌরাঙ্গসুন্দর মৃদঙ্গ কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে বোল তুলছে তাতে। এখন গান না গাইলে তিনি যদি রেগে যান!

মালতী মনে মনে বলল, হে গোপীনাথ, তুমি আমাকে সঙ্গ দাও। আমাকে তরিয়ে দাও এই পরীক্ষা থেকে। ঝর্ণার মতো মালতীর কণ্ঠ থেকে সৌন্দর্য ঝিকিমিকি করে উঠল মহাজনী পদাবলি হয়ে ঃ

“ধৈরজ না ধরিতে না পারি সহিতে

অনুরাগে তনু ঝরে।

কৃষ্ণ পিপাসায় যায় যায় প্রাণ যায়

সখী ধরলো ধর আমারে।

কৃষ্ণ অনুরাগে অঙ্গ আমার জ্বরো জ্বরো

ধরো ধরো আমায় ধরো …”

মালতী আড়াআড়ি বসেছে মন্দিরে গোপীনাথের পায়ের কাছে। বাঁ দিকে আসনে বাঁকা গোপীনাথ আর ডান দিকে মন্দিরের প্রাঙ্গনে মৃদঙ্গে মূর্ছনা তুলেছে গৌরাঙ্গসুন্দর। মালতী গৌরাঙ্গের উপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না এক পলকও। এই চণ্ডীদাসের পদের প্রতিটি শব্দ সুরে ফেলে মালতী গৌরাঙ্গকে নিবেদন করছে যেন। গৌরাঙ্গ মালতীর গানে না কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর বোঝা যাচ্ছে না। তবে সে ঘোরের ভেতর ঢুকে গেছে। দ্রুত লয়ে তেওট তালে মৃদঙ্গ বাজাতে বাজাতে নিজের পায়ের পাতার উপর উঠে সে এসময় নৃত্যরত।

মালতীরই চোখে পড়েছে হই হই করতে করতে এক দঙ্গল ছেলে-ছোকরা নিয়ে তার দাদা মাধবস্মরণ ঢুকছে। সে উচ্চকণ্ঠেই বলল, “ নিমাই তোমার সব কাজ আমি নিজেই সেরে ফেলেছি। চরের মাঠে তাঁতিপাড়া, কুমোরপাড়া, জেলেপাড়া, চাঁড়ালপাড়ার ছেলেরা জড়ো হয়ে গেছে। আমি এই গোপপাড়ার ছেলেদের জড়ো করে নিয়ে আসতে গিয়ে কিছুটা বিলম্ব হল। চলো চলো নবদ্বীপের অলিগলি আজ নাম সংকীর্তনে মাতিয়ে দেব আমরা।”

মালতীর গান থেমে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু গৌরাঙ্গসুন্দর তখন খোলে মূর্ছনা মেলছে। সমে না পৌঁছে সে তো ছাড়বে না। গৌরাঙ্গসুন্দর কোনো কাজ অর্ধেক করে না। সবটাতেই সৌন্দর্য সুষমা দিয়ে পরিপূর্ণতা এনে দিতে চায় সে। ফলে মাধবস্মরণের কথা কানে গেলেও নিমাই আরো খানিকটা মৃদঙ্গ বাজিয়ে তবে থামে। আর গোপীনাথকে প্রণাম করতে মন্দিরে উঠে এসে মালতীর পাশেই হাঁটু মুড়ে বসে। ভূমিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে করতে বলে,

“ মালতী, কাল অপরাহ্নে একবার পুবপাড়ার মাঠে এসো তো। কথা হবে ।”


নন্দরানীকে নিয়ে ঘাস খাওয়ানোর জন্য বেরোনো শুধু অজুহাত নয়। একলা পথে নন্দরানীই যে তার বল-ভরসা। নন্দরানীই যে তার সই। ছোটো বড় সব কথা তাকেই বলা চাই। পুবপাড়ার মাঠ ঘাসের মখমল যেন। নন্দরানীকে ঘাস খেতে বলে দিয়ে মালতী মাঠের পাশে যে তিন-চারটে তমাল তরু আছে তার নীচে বসে পড়ল। সূর্যের দিনের কাজ প্রায় শেষ। সবুজ ঘাসের উপর তেরচা হলুদ এসে বসায় কেমন একটা মায়া রং খুলেছে। মালতী আরো দেখলো বেশ কিছু ফড়িং প্রাণের আনন্দে খেলা করছে, বসছে ঘাসে। ফড়িং-এর ওড়াটুকু ছাড়া গোটা প্রকৃতিই ছবি আঁকা হয়ে যেন পড়ে আছে।

আগের দিন দুপুর থেকেই মালতী যেন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে চলেছে। শুধু নবদ্বীপ নয়, মালতী দাদা মাধবস্মরণের কাছে শুনেছে নিমাই পণ্ডিতের নাম নদিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি আচার্য অদ্বৈতের কাছে শুনেছে তার দাদা মাধবস্মরণ নিমাইয়ের গুণগান। তিনি বলেন, এই আঠারো বছর বয়সে যদি নিমাইয়ের এত নাম, তাহলে একটু পরিণত বয়সে সে তো গোটা বাংলার সারস্বত সমাজের নয়নের মণি হয়ে উঠবে! এই বলার ভেতর নিমাইয়ের বন্ধু মাধবস্মরণ অদ্বৈতের অসূয়াও টের পেয়েছে।

মাধবস্মরণ রাতের বেলায় যখন একসাথে বাবা-মা, বোন মালতীর সাথে খেতে বসে, তখন প্রায় রোজই নিমাইয়ের প্রসঙ্গ না তুলে পারে না। তার সব কথাতেই মিশ্র বাড়ির ছোটছেলে নিমাই জুড়ে থাকবেই। নিমাইয়ের কথা বলতে পারলেই যেন মাধবস্মরণের আনন্দ। তবে সে পরিতাপের সুরেও বলে, নিমাই বেশিরভাগ সময় কাটায় নিজের টোলে ছাত্রদের সাথে আর রাস্তা-ঘাটে, মন্দিরে, মঠে কৃষ্ণনাম গেয়ে। বাড়িতে যেতেই নাকি তার ভয় করে। সেখানে মা শচীদেবীর সাথে নিমাইয়ের বধূ লক্ষ্মীপ্রিয়ার খটাখটি চলতেই থাকে। নিমাইয়ের মা কথায় কথায় বাড়ির বৌকে খোঁটা দেন, “ কোনো কথা বলবে না। কী নিয়ে এসেছ এ বাড়িতে অ্যাঁ? বাপ তো পাঁচটা হরিতকি দিয়ে কন্যাদায় থেকে উদ্ধার হয়েছে।”

মালতী ঘাসের নরম আসনে বসে গৌরাঙ্গসুন্দরের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। গতকাল বিকেল থেকেই তো এখানে আসার জন্য মনের প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছিল। রাতে প্রহরে প্রহরে জেগে উঠেছে। কই, সকাল হল! সকাল সকাল সব গৃহকাজ সেরে ফেলতে হবে। তারপর নিজেকে সাজানো। উত্তেজনায় রাতে ঘুম হতেই চায়নি। আজ সে মুঞ্জফুল শাড়ি, রেশমের কাঁচুলি পরেছে। গলায় দিয়েছে নিজের হাতে বানানো জুঁইফুলের মালা। তাজা জুঁইফুলের গন্ধে নিজেরই ভালো লাগছে মালতীর।

গৌরাঙ্গের হাতের ছোঁয়ায় যেমন সে জেগেছে, তেমনি কেঁপে উঠেছে তার শরীর। মালতীর খোলা কাঁধের উপর হাত দিয়ে গৌরাঙ্গ বলেছে, “ কী হলো সখী, ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি!”

আবারও বোবায় ধরেছে যেন! স্বপ্ন কীকরে যে সত্যি হতে লেগেছে কে জানে! এ নিশ্চই গোপীনাথের কৃপা। গোপীনাথই তো তাকে এই সোনারবরণ হৃদয়হরণকে তুলে দিয়েছে। মালতী দ্রুত ভেবে নেয়, সেদিন যদি গোপীনাথকে সে গান শোনাতে না বসত, তবে গৌরাঙ্গসুন্দর তার গানের সাথে মৃদঙ্গ বাজাতেনও না। গানের মাঝে চোখ ঝাপসা হয়ে ভয় পেয়ে মূর্ছা না গেলে গৌরাঙ্গের কোলে উঠতে পারত না। গৌরাঙ্গকে বাদনরত রাখতে নিজেও দ্বিতীয়বার গান গাইত না।

গৌরাঙ্গ বলল,“ আচ্ছা সুন্দরী, বলো তো কাল ওই মহাজনী পদ কাকে উদ্দেশ্য করে গাইছিলে! তা কি কৃষ্ণপায়ে নিবেদন করা, নাকি আমার জন্য গাওয়া?”

একেতেই নবদ্বীপের নয়নের মণি তার পাশে এসে বসেছেন ভেবেই নুয়ে যাচ্ছে মালতীসুন্দরী। তারপর আবার এরকম কথা সোজাসুজি জিজ্ঞেস করতে আছে! মানুষটা যে ডাকাবুকো তা শুনেছিল মালতী। কিন্তু এতটা স্বাভাবিক সাহসী সে ভাবেনি। নবদ্বীপে বাড়িতে তাঁর নিজের স্ত্রী আছে। তা স্বত্ত্বেও মালতীর কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে এখানে গৌরাঙ্গসুন্দর!

“ কী হলো, কথা বলছ না! আমাকে কি পছন্দ নয়! তাহলে আমি চলে যাই?”

“ না না প্রভু। আমার জীবন ধন্য করে, স্বার্থক করে আপনি এসেছেন। গোপীনাথের কৃপায়, আমি এই পরম নিধি বুকের ভেতর ভরে নিয়েছি সেদিনই, যেদিন প্রথম আপনাকে দেখেছিলাম। প্রভু, আপনার এই সান্নিধ্যটুকু নিয়ে এখন আমার মরে গেলেও কোনো অনুতাপ নেই। এক তুচ্ছ গোয়ালা জন্মের অন্ধকারে থাকা মূর্খ মেয়েমানুষ আমি জানি না কীভাবে আপনাকে আবাহন করব। আমার ভুল হয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন।”

“ এই তো বেশ কথা বলতে জানে দেখছি মালতীসুন্দরী। তবে তোমার গানে আমি কিন্তু দ্রবীভূত হয়ে আছি মালতী। আমাকে আবার গান শোনাবে তো?”

মালতী মাথা নাড়ে। গৌরাঙ্গ তাকে এক হাত দিয়ে আলিঙ্গন করে বুকের ভেতর টেনে নিয়েছে। একটুকু বাদেই বলে, “ একটা খুব সুন্দর গন্ধ আছে তোমার শরীরে। বেশ মিষ্টি সে গন্ধ।”

গৌরাঙ্গসুন্দরের বুকের ভেতর ছোট পাখিটির মতো কেঁপে কেঁপে জীবনের পরম পাওয়ার সুখ নিতে নিতে মালতী কথা বের করল অল্প করে, “ ওটা আমার গলার জুঁইফুলের মালার গন্ধ।”

“ কই, তাই নাকি! ওটা আমায় দাও তো। দাও। দেবে না?”

কেঁদে ফেলল মালতী। “ কী বলছেন প্রভু। আজ থেকে আমার সবটুকুই আপনার। আর এই সামান্য ফুলের মালা দিতে পারব না! নিন, আপনি খুলে নিন।”

“ না না। তুমি নিজের হাতে আমাকে পরিয়ে দাও। তাতে আমার মনে হবে তুমি আমাকে গ্রহণ করলে মালতী।”


পুকুরের জলে এসময় যেন মালতীর খোলা বুক নয়, খোলা মন তির তির করে সাঁতরাচ্ছে। মালতীর চোখে পড়ল পুকুরের কোণের হেলেঞ্চার ঝোপের উপর দু-তিনটে ফড়িং খেলা করতে করতে তার গায়ের কাছ থেকে ঘুরে যাচ্ছে বারবার। দু-একবার একটা লাল রঙের ফড়িং-এর ডানা যেন তার খালি পিঠ ছুঁয়ে দিয়ে গেল। সিরসির করে উঠল সমস্ত শরীর। এই ফড়িংটিকে চেনা লাগছে যেন তার! মনে পড়েছে। পুবের মাঠে তমাল গাছের নীচে গৌরাঙ্গসুন্দরের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকার সময় দু-তিনটে ফড়িং এরকম ঘুরে যেত। কিন্তু তাও তো অনেক বছর হয়ে গেছে! তা আট নয় বছর হবে। এতদিন পরেও সেই ফড়িং কি মনে রেখেছে তাকে! মালতী বুকজলে দাঁড়িয়ে ভাবল ডেকে একবার কথা বলা যাক না! সে তাকে চিনতে পারছে কি না জিজ্ঞাসা করা যাক না!

আজ সকালে দুধ দোয়ানোর আগে নন্দরানীকে অনেক অনেক কথা বলেছে। কেঁদে ভাসিয়েছে খুব। নন্দরানী লেজ দিয়ে মৃদু মৃদু ঝাপট মেরেছে যেমন তেমনই লম্বা জিভ দিয়ে মালতীর সোনার বরণ হাত চেটে চেটে সান্ত্বনা দিয়েছে। তাকে শান্ত হতে বলেছে।

কিন্তু কীকরে শান্ত হবে! এতগুলি বছর, মানে প্রায় চার বছর গৌরাঙ্গসুন্দর নেই নবদ্বীপে। নবদ্বীপ ছাড়ার আগের দু-তিন বছরও দেখা করেনি সে মালতীর সাথে। হ্যাঁ, এর ভেতর প্রথম বউ লক্ষ্মীপ্রিয়া মারা গেছে। আর তারপর আবার বিয়ে করেছে গৌরাঙ্গসুন্দর বিষ্ণুপ্রিয়াকে। বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মীপ্রিয়ার থেকে ঢের সুন্দরী। লক্ষ্মীপ্রিয়ার মতো প্যাকাটিমার্কা চেহারা নয়। গৌরাঙ্গসুন্দর যে দু’বছর মালতীর পাশে ছিল, তা থেকে জেনেছে গৌরাঙ্গের পছন্দ একটু গোলগাল, নাদুসনুদুস সুন্দরী। মালতীও যে মোমের পুতুলের মতো নাদুসনুদুস সুন্দরী। গৌরাঙ্গ নিজে দীর্ঘকায় আর শালবৃক্ষের মতো শরীরের মেদহীন পুরুষ হলেও তার পছন্দ একটু মেদযুক্ত রমণী।

সকালে কাঁদতে কাঁদতে নন্দরানীকে বলছিল মালতী, “ তিনি বিবাহিত জেনেও আমি তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছি। তিনি খুবই নামী আর দামি মানুষ জেনে আমি সমস্ত বিরহকে বহন করে গেছি এতকাল। কিন্তু কাল এ কী কথা শোনাল দাদা মাধবস্মরণ! বল নন্দরানী, আমি কীকরে নিজেকে সামলাই!”



নন্দরানী হয়ত মালতীর হাত জিভ দিয়ে চেটে জিজ্ঞেস ক ৭রেছে, “ কেন নতুন কী হলো আবার! সে তো এমনি এমনি এই নবদ্বীপ ত্যাগ করেনি! তুমি জানো মালতীসুন্দরী সে প্রাণের ভয়ে এখান থেকে চলে গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে অদ্বৈত আচার্য এক ছাত্রবাহিনীকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা কাজীর সাথে ষড় করে ফেলেছিল। কাজী যেকোনো দিন তাকে গ্রেপ্তার করে গুমঘরে চালান করে দিত। এসব কথা তুমি তো জান মালতীসুন্দরী! সে মারা গেলে তোমার কষ্ট হত না ?”

“ নন্দরানী, তার মারা যাবার কথা বলিস না। বেঁচে আছেন, এই সংবাদটুকু নিয়েই তো আমি এতকাল একা একা নিজেকে সামলাচ্ছি। বল নন্দরানী, আমার এই ভরা যৌবন যে নিজে নিজে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। আর সে জন্য আমি কি কখনও অনুতাপ করেছি! করিনি। আমি যে তাঁকে একবার পেয়েছি, সেই স্মৃতি বুকে করেই কাটিয়ে ফেললাম এতগুলো বছর। কখন কি কোনো অনুযোগ করেছি!”

নন্দরানী লেজের ঝাপট দিয়ে বলল, “ তাহলে আজ এতটা উতলা লাগছে কেন তোমাকে?”

শাড়ির আঁচলে চোখ ও নাকের বিরামহীন বয়ে যাওয়া জল মুছে ধরা গলায় বলল, “ কাল বিকেলে দাদা ফিরেছে অন্য কয়েকজন পরিকরদের সাথে। সে-ই পুরীর কথা বলছিল। খেতে বসে আমার তো মুখে অন্ন উঠছিল না। আমি দাদার মুখ থেকে যতটুকু তাঁর কথা বের হচ্ছিল, সব কান দিয়ে চেটেপুটে নিচ্ছিলাম। গৌরাঙ্গ নাকি বলেছেন বাংলার পরিস্থিতি ভালো হলে তবেই আসবেন এখানে। নিত্যানন্দ আর আমার দাদাদের কয়কজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি বাংলার বৈষ্ণবদের হাল ধরতে। বলেছেন, সব মানুষকে বুকে টেনে নিতে হবে।”

একটু থামল মালতী। তারপর কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে বলল, “ সব মানুষের কথা মনে থাকে, আমার কথা মনে থাকে না! আমাকে বুকে টেনে নেবার ইচ্ছে হয় না তাঁর!”

নন্দরানীর ঘনকালো, খুব বড় চোখ দিয়ে তখন অল্প অল্প জল বের হচ্ছে। সে মালতীর কান্না সহ্য করতে পারছে না। আবার সান্ত্বনা দিতেও ঠিক পেরে উঠছে না। তার তো মুখে তেমন ভাষা নেই। কতদূর জিভ আর লেজ দিয়ে মালতীর বুকের ব্যথা মুছে দেয়া যায়! কিন্তু চেষ্টা সে ছাড়তে রাজি নয়। নন্দরানী এবার জিভ বুলিয়ে দিল মালতীর চোখের জলে ভেজা মুখমণ্ডলে। ওই ছোঁয়া দিয়েই সে বলল, “ অত ভেব না। বাংলা একটু শান্ত হলেই তো তিনি আসবেন। তখন নিশ্চই তোমার সাথে দেখা করবেন।”

“ ছাই করবে নন্দরানী। তাঁর কি আমাকে মনে আছে! তিনি বিদেশে গিয়ে লায়েক হয়েছেন। সেখানে নাচে-গানে, কথার তোড়ে প্রতাপরুদ্র রাজাকে বশ করেছেন। তাঁর অনেক শিষ্য সামন্ত হয়েছে। আর তাদের ভেতর সুন্দরীদেরও অভাব নেই। দাদা বলল, সে সন্ন্যাস নিলেও এখন পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের কন্যা সুন্দরী শাটীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। নন্দরানীরে, আমার কপাল পুড়েছে। লক্ষ্মীপ্রিয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। আমার গোপীনাথও যে বিয়ে করা বঊ ছেড়ে রাধাকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন। আমিও জানতাম গৌরাঙ্গসুন্দরের রাধা আমি। কিন্তু ওই উড়িষ্যার শটী সুন্দরীর কথা শুনে যে আমার বুক ভেঙে গেল নন্দরানী।”

পুকুরের জলের উপরে মালতী তার অঙ্গবাস খুলে ভাসিয়ে দিয়েছে। বুকের কাঁচুলি, পরণের শাড়ি মালতীর হাতে তৈরি জলের ঢেউ-এর ধাক্কায় খানিকটা ভেসে থাকতে থাকতে দূরে চলে যাচ্ছে। ফড়িংটিকে ডেকে এবার জিজ্ঞাসা করল মালতী, “ ফড়িং, তুই আয় তো। দেখ তো, আমায় ভালো করে দেখতো, আমার রূপ যৌবন কি কম হতে বসেছে! আমি কি ফুরিয়ে যাওয়া নারী ! নাহলে আমার প্রেমিক কীকরে আমাকে ভুলে অন্য প্রেমিকাকে বুকে টেনে নিচ্ছে এখন!”

মালতী নিজেকে একটু উঁচু করে তুলে ধরতে চাইল ফড়িং এর চোখে। সে পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে তার খোলা বুক যতটা সম্ভব জলের উপরে তোলা যায়, তুলে ধরে বলল, “ দেখ তো, এরা একটুও আনত হয়েছে কিনা! যদি না হয়, তবে তিনি কেন আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন! বল ফড়িং, তুই আমারে বল!”



মালতীকে ঝুপুস ঝুপুস কাঁদতে দেখে ফড়িং-এরও মনখারাপ হয়েছে। সে নিজের ডানায় সোঁ সোঁ শব্দ তুলে কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু না পেরে মালতীর বাম কাঁধের উপর এসে বসল। শুঁড় নেড়ে নেড়ে তার চিকন চামড়ার উপরে কত যে কথা রাখল, তার ঠিক নেই ।

ফড়িংকে কাছে পেয়ে কান্নার বেগ কিছুটা কমেছে মালতীর। সে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “ তুই তো দেখেছিলি তাঁকে পুবের মাঠে আমার সাথে। বল তাঁর কি উচিত হয়েছে আমাকে ভুলে থাকা!”

ফড়িং হয়ত মালতীর কাঁধে শুঁড় বুলিয়ে বলেছে, “ একটু শান্ত হও এখন।”

মালতী মনে মনে বলে, কীকরে শান্ত হব! আমার বুক যে ভেঙে গেছে ফড়িং। সে চণ্ডীদাস কণ্ঠে নেয়ঃ

“ সই, কেমনে ধরিব হিয়া?

আমার বঁধুয়া, আন বাড়ি যায়,

আমার আঙিনা দিয়া!

সে বঁধু কালিয়া, না চায় ফিরিয়া,

এমতি করিল কে?

আমার অন্তর, যেমন করিছে,

তেমতি হউক সে। ”

মালতী জলে ডুব দিল এবার। ফড়িং দেখল পুকুরের জল একটা জায়গায় বুড়বুড়ি কাটছে। জল ঘুরে ঘুরে বৃত্ত তৈরী করছে সেখানে। ফড়িং সেই বৃত্তের উপর ঘুর-পাক খেল অনেকক্ষণ। কিন্তু মালতীকে আর দেখতে পেল না।

 


তাপস রায়:  এম এ,  পিএইচ ডিকেন্দ্রীয়   সরকারের আধিকারিকপ্রকাশিত কবিতার বইঃ মে মাস নরম হয়ে আসে (সিগনেট ) ২০১৭ বিকেল পাঁচটা এসে বসে আছে চায়ের দোকানে (প্রথম আলো) ২০১৪ বাউন্ডুলে রোদ্দুর (একুশ শতক) ২০১৫ গঙ্গাকে বাইপাসে নিয়ে গেলে (এবং মুশায়েরা ) ২০০৮ ব্যবহারিক রূপবিজ্ঞান তত্ত্ব (কৃত্তিবাস ) ২০০৬ মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষ (অনুষ্টুপ) ২০০৪ কলের গান ( কবিতা পাক্ষিক ) ২০০০ ৩১নং জাতীয় সড়ক ( প্রো রে নাটা ) ২০১০ বনবিবির বসতি (কবিতা ক্যাম্পাস) ১৯৯৪ হে পুরাণ প্রথা ও প্রাচীর  (কবিতা ক্যাম্পাস ১৯৯৬) উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কবিতাঃ অনুবাদ ও ভূমিকা (বইওয়ালা ) ২০০২ আবার নদী লিখছি, গাছপালা, বাড়ি (সুতরাং) ২০২৪ প্রবন্ধের বইঃমিথ্যে মিথ্যে কবিতা (সুতরাং ) ২০১৭ গল্পের বইঃদশে দশ (একুশ শতক) ২০১৬, সুলভ শৌচালয় (একুশ শতক)২০১৯ যদিদং টু তদস্তু (বরাহনগর দর্পণ) ২০২৩ উপন্যাসঃ পোড়ামাটির দেউল (আনন্দ) ২০১৬, মানদাসুন্দরীর কাঁথা (আনন্দ) ২০১৮ নিহত গোলাপ (একুশ শতক) ২০১৮,বন্দেমাতরম,(একুশ শতক) ২০২২ ব্যাটলশিপ (একুশ শতক) ২০২৩, মালতী মাধবী কুঞ্জ (ভিরাসত)২০২৩ পুঁটি মাসির মিশির শিশি (সুতরাং) ২০২৩ রায়গুণাকর (পত্রপাঠ) ২০২৩, গরানহাটির কীর্তনীয়া ( লালমাটি) ২০২৪ সহজ গোঁসাই (পত্রপাঠ) ২০২৪। বিলিতি বৌঠান (ভিরাসত) ২০২৫ পুরস্কার বীরেন্দ্র পুরস্কার, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত স্মারক ,সামসুল হক স্মৃতি পুরস্কার, বেদব্যাস পুরস্কার, বিনয় মজুমদার স্মৃতি পুরস্কার, উত্তরণ সাহিত্য পুরস্কার, কবি নিত্যানন্দ পুরস্কার, সুতরাং,  প্রথম আলো, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী স্মৃতি সম্মাননা