রাধানাথ ~ প্রকাশ চন্দ্র রায়

 





রাতদুপুরে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রাধানাথ। কাঁদছে তো কাঁদছেই! জোর গলায় সে কি কান্না! কান্নার ধমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে বিছানা বালিশ।

 

ও ঘর থেকে হুড়মুড় করে ছুটে এলো বাবা রমাকান্ত মাষ্টার আর মা সুশীলা দেবী।

পাশের ঘরে বোন আদুরী তখনও ফেসবুকের চ্যাটিংয়ে মশগুল।

বদ্ধ কপাটে করাঘাত করে ডাকছে রমাকান্ত মাষ্টার-

- বাবা, বাপধন, কী হলো, কী হলো তোমার?

মা সুশীলা দেবী উদ্বিগ্ন কন্ঠে স্বামীর স্বরে স্বর মিলিয়ে ডাকছে

- এ্যাই সোনা, রাধা, ও রাধা দরজা খোল বাবা-খোল তাড়াতাড়ি।

ডাকাডাকির এত উত্তাল শব্দেও কর্ণপাত নেই রাধানাথের। কেঁদেই চলেছে সে কোল বালিশে মুখ গুঁজে।

 

সদ্য এম, এ পাশ করা পরিপূর্ণ একজন যুবক পুরুষ জোর গলায় কাঁদতে পারে ষাটোর্ধ্ব বয়সী রমাকান্ত মাষ্টার ভেবেই পাচ্ছে না যে, জীবনে সে কখনও এরকম ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল কি না!

বাধ্য হয়েই ডাকতে হলো আদুরীকে। 

অতিশয় বিরক্তির সাথে উঠে এসে দাঁড়ালো আদুরী বাবা মায়ের কাছে।

-এ্যাই দাদা, তুই কি রে? পুরুষ না কী ভেড়া রে?

পুরুষ কখনও বড় গলায় কাঁদে রে? কান্না থামাও নচেৎ গোপন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছি কিন্তু।

 

তার আর প্রয়োজন পড়লো না, আদুরীর কন্ঠস্বর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই জলন্ত ম্যাচের কাঠি জলে চুবাইলে যেমন ছ্যাৎ করে নিভে যায়-রাধানাথও তেমনি নিঃশ্চুপ হয়ে গেল। ঘরের ভিতর থেকে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্তও আর শোনা যাচ্ছে না।

 

বাবা তার মেয়ের রহস্যময় কথার বিন্দু বিসর্গ কিছুই বুঝল না তবে অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে মেয়েকে নিয়ে পড়লো।

-কী সে গোপন তথ্য মা মনি?

এবার ঘরের ভিতর থেকে রাধানাথের গর্জন শোনা গেল-গর্জন না বলে ভেড়ার ডাক বললেই বোধহয় ভাল হবে।

-এ্যাই আদুরী, খবরদার বলবি না, না বোন-না।

একবার গর্জন করেই পলকে অনুনয় ঝরে পড়ছে তার কন্ঠ থেকে-

-তোকে আমি একটা ভাল গিফট কিনে দেব কালকেই তবুও বলবি না-খবরদার।

 

শেষের কথাগুলো আদুরীর কানে গেল কি না, তার আগেই সে দুপ দাপ করে পা ফেলে চলে গেল নিজের ঘরে।

 

স্বামী স্ত্রী উভয়েই কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পা বাড়ালো মেয়ের ঘরের দিকে।

 

স্বামী-স্ত্রী মেয়ের ঘরে ঢুকে হতবাক। এতবড় একটা ঘটনার পরেও আদৃতা সরকার আদুরী'র মুখাবয়বে কোন উৎকন্ঠার ছাপ নেই! নির্বিকারচিত্তে সে ফেসবুক চালিয়ে যাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে।

 

মা সুশীলাদেবী পাশে বসে মেয়ের গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

-তোর দাদার কী হয়েছে মা?

বাবাও বলল,

-বল মা কী হয়েছে রাধা'?

আদুরী ঈষৎ কৌতুক করে বলল,

-ঐ তো বাবা-দেখো কোটেশনে কি লিখলাম।

এই বলে সে তার মোবাইল সেট'টা বাবার হাতে দিলো।

 

রমাকান্তবাবু হাতে নিয়ে কৌতুহল ভরে দেখল-আদুরী লিখেছে,

 

"সুখের খবর আকাশে উড়ায়,

দুঃখের খবর পাতালে হারায়"।

 

রমাকান্ত বাবু বিরক্তির স্বরে বলল.

-রাখ তোর কবিতা আর ছন্দ। কী হয়েছে তাই বল আগে।

সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে বললো

-ঐ তো বাবা! মাষ্টার হয়েও বুঝলে না।

 

মা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,

-মা সোনা, কী হয়েছে তোর দাদার ?

 

আদুরী তার রচিত ছন্দের জের টেনে বলল,

 

-আচ্ছা মা, উত্তর পাড়ায় অত কীসের শব্দ হচ্ছে!

মা বলল,

-যদু চেয়ারম্যানের মেয়ের বিয়ের বাজনা বাজছে। এবার আদুরী বলল,

-বিয়ে হচ্ছে সেটা সুখের খবর নাকি দুঃখের খবর?

বাবা বলল,

-সুখের খবর।

-তাই তো বাবা, খবরটি আকাশে বাতাসে উড়ছে।

আর তোমার শিক্ষিত ছেলে রাতের আঁধারে ডুঁকরে কাঁদছে-এই দুঃখের খবরটা গায়েব হয়ে যাচ্ছে পাতালে।

 

আদৃতা সরকার আদুরী। তেজস্বী, রূপসী, চটপটে মেধাবী, মুখরা ও প্রতিবাদী মনস্ক মেয়ে। স্থানীয় কলেজ থেকে সে-ই একমাত্র জি, পি, এ গোল্ডেন-৫ পেয়ে ইন্টার পাশ করে, বেশ ক'টা ভার্সিটিতে ভর্তির দরখাস্ত করে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফেসবুকে কবিতা লেখার সুবাদে এখন বেশ পরিচিতি তার। কলেজ লাইফে খেলাধুলা, রাজনীতি, সাহিত্য সংগঠন  সর্বক্ষেত্রেই প্রায় স্বর্ণ-স্বাক্ষর আছে তার। উপজেলা ছাত্রলীগের মহিলা সম্পদিকা সে।

 

অপরদিকে তার দাদা রাধানাথ লাজুক, মুখচোরা, ভীরু, বইয়ের পোকা বিধায় ব্রিলিয়ান্ট। ভাইবোনের চরিত্র বিপরীতমুখী। ভাই যে কাজে বলে পারব না-বোন উল্টোটা বলে, আমি পারবোই। তাই তো বোন বলে

 

-দাদা তোর রাধানাথ নামটাই অনেক সেকেলে আর নেতিবাচক নাম। মানলাম রাধানাথ শিকদার চীপ সার্ভেয়ার হিসেবে হিমালয়ের সর্ব্বোচ শৃঙ্গের উচ্চতা নির্দ্ধারণ করেছে কিন্ত তাকে ধাপ্পা দিয়ে তো জর্জ এভারেষ্ট নিজের নাম বসিয়ে নিয়েছে। তার মানে রাধানাথ শিকদার ইজ এ ফেইলুর পারসন। অপরদিকে কৃষ্ণ'র আরেক নাম রাধানাথ-সেও কিন্তু ফেইলুর পারসন, কারন শ্রীরাধাকে সে তো বিয়ে করতেই পারেনি। তাহলে তার (রাধা'র) নাথ বা স্বামী হল কেমন করে সে।

-এই দ্যাখ দাদা, তুই  হলি শশক জাতীয় পুরুষ-

ভীত সন্ত্রস্ত উৎকন্ঠিত। আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে রিস্ক নিতে অপারগ। সে কারণেই চেয়ারম্যানের মেয়ে কৃষ্ণা'র তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারিসনি। বান্ধবীটা আমার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল তোকে ধরে রাখার জন্য। তুই তোর আত্মবিশ্বাসের অভাবেই তাকে অর্থনৈতিক ও সামজিক অসামঞ্জস্যতার দোহাই দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখান করলি। বেচারী কৃষ্ণা এখন বাবা মায়ের চাপে পড়ে অনিচ্ছা সত্বেও অপছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে, আর তুই রাধাহীন 'রাধানাথ' হয়ে দিনরাত ঘরের কোণে পড়ে আছিস আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিস।

 

মাত্র তিনদিন পূর্বে উপরোক্ত দার্শনিক বক্তব্যগুলো উপস্থাপন করেছিল আদুরী তার ভেড়া প্রকৃতির দাদা'র সামনে। আজ বাবা মায়ের সামনে নিঃসংকোচে পুনরুদ্গীরণ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

 

বাবা, মা আর বোন আদুরী চলে যাওয়ায় অদ্ভুত একটা স্বস্তিকর প্রশান্তিতে ভরে গেল রাধানাথের মন। প্রচন্ড ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন শান্ত ভাব ধারন করে-ঠিক তেমনি শান্ত অথচ অসাড় অবশ দেহমন নিয়ে আলুথালুভাবে দেহটাকে বিছিয়ে দিল বিছানায়।

 

সুনসান প্রকৃতি, কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। মেইনরোড সংলগ্ন জানালটা খোলার অদম্য ইচ্ছাটাকে দমন করতে পারছে না কোন মতে অথচ ক্লান্ত দেহমন নিয়ে হাত বাড়িয়ে জানালার ছিটকিনি খোলার শক্তিটুকুও যেন অবশিষ্ট নেই আর দেহে তার। উত্তর পাড়ার চেয়ারম্যান বাড়ী থেকে কৃষ্ণার বিয়ের বাজনার শব্দ ভেসে আসছে। জানালা খুললেই হয়তো রঙ্গিন আলোকসজ্জা'র বিচ্ছরিত কিয়দংশ চোখেও পড়তো।

 

সাতপাঁচ ভেবে শেষে জানালা খোলার আকাঙ্ক্ষাকে জোর করে তাড়িয়ে দিল সে মন থেকে। ভাবছে রাধানাথ-

 

-তোমার স্নেহের বিনিময় দিতে আমি অকাতরে এ প্রাণ বলি দিতে পারি বাবা। কৃষ্ণা তো কোন ছাড়!

যে অপরিসীম কষ্ট করে তোমরা আমাকে এতদূর পর্যন্ত মানুষ করে এনেছ মা, তার প্রতিদান যেন তোমাদের জীবিতাবস্থাতেই দিতে পারি সেই আশীর্বাদ করো। যতটাকা ঋণগ্রস্থ হয়েছ বাবা, তার একমাত্র কারন তো আমিই। জানি তোমাদের অগাধ অপত্য স্নেহ শেষে হার মেনে যেত আমার অনুচিত আবদারের কাছে।

কৃষ্ণাকে বউ করে ঘরে তুললে পরবর্তীতে সামজিক,অর্থনৈতিক. কৌলিক অসামঞ্জ্যতা হেতু যত কিছু দূর্ভোগই পোহাতে হত না কেন-সব কিছুই নতমস্তকে মেনে নিতে তোমরা একমাত্র ছেলের মুখপানে চেয়ে।

ইত্যাদি অতীত বর্তমানের সঙ্গত, অসঙ্গত নানারূপ ভাবনা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল রাধানাথ। হঠাৎ জোরালো বাজনার শব্দে ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসলো, দেখল সকাল হয়ে গেছে। বিয়ের বাজনা ক্রমশঃ যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে। জানালা খোলার অদম্য ইচ্ছের কাছে এবার হার মেনে নিয়ে হাট করে খুলে দিল জানালার কপাট দুপাট। দেখলো,

পাড়ার আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। জোরালো বাজনার সাথে পুষ্পমাল্য সজ্জিত বরকনের গাড়ীকে সামনে নিয়ে এগিয়ে আসছে বরযাত্রীদের গাড়ীবহর। পুষ্পমাল্য শোভিত গাড়ীটাতে নিশ্চয় তার বরসহ বসে আছে কৃষ্ণা। রাস্তায় দাঁড়ানো সবাই হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। স্তব্ধ, বিমূঢ় রাধানাথ জানালায় মাথা রেখে ঠায় বসে থাকলো।

 

বেশ অনেকক্ষণ হলো বিয়ে বিদায়ের গাড়ীবহর চলে গেছে। থেমে গেছে সমস্ত কোলাহল, কেবল পথচারীগণ যাওয়া আসা করছে। দু'একটা রিক্সা ঠুং ঠাং বেল বাজিয়ে চলাচল করছে পথে। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল রাধানাথ।

 

আবারো হাউমাউ করে ডুঁকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে হল তার, কিন্ত কাঁদতে পারছে না কেন যেন! শোকে,দুঃখে, বিরহে কাতর রাধানাথ স্তম্ভিত, বিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে ভারী পাথর এর মত ধুপ করে পড়ে গেল তার বিছানায়।


প্রকাশ চন্দ্র রায়,একজন হোমিওপ্যাথ।পেশাগত ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে অবসরে সাহিত্য চর্চা করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "তামাটে হৃদয়ভূমি"। ১৯৬২ ইং জন্মগ্রহণকারী এই লেখক কবি'র বাড়ী-বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলায়।