লাশকাটা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনিমেষ একইসাথে পচা ইঁদুর আর দেশী মদের সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া উগ্র গন্ধটা টের পাচ্ছিলো। ঘরটার ভেতরে সীমার থেঁতলে যাওয়া শরীরটাকে ওরা এখন কাটা ছেঁড়া করছে। অনিমেষের মনে পড়ে গেলো, সীমা প্রত্যেকবার দেখা করতে এসে ওকে একটা করে অপরাজিতা ফুল দিতো। অনিমেষ হাসতো। অপরাজিতা কি একটা দেওয়ার মতো ফুল হলো? গন্ধও নেই। সীমা বলতো, "যেদিন তুমি অপরাজিতার গন্ধ পাবে, সেদিন বুঝবে তুমি আমায় সত্যিই ভালোবাসো।" সীমা এতো কনফিডেন্টলি বলতো, অনিমেষের তর্ক করতে মন যেতো না। মনে হতো, হতেও তো পারে, কত কিছুই তো হয়। আচ্ছা এখন ওই লাশকাটা ঘরটা থেকে যে গন্ধটা আসছে, ওটাই কি অপরাজিতার গন্ধ? না কক্ষণো না। অপরাজিতার গন্ধ নিশ্চয়ই আরও ঢের সুন্দর। আসলে বয়সে বেশ খানিকটা বড় হলে কি হবে, সীমার অনেক কথাই অনিমেষ বুঝতে পারতো না। যেমন বুঝতো না, সীমা প্রথম দিন থেকেই সব ব্যপারে এতোখানি নিশ্চিত কিভাবে? গেলো বছর শীতে সান্ধ্যকালীন আড্ডা সেরে ক্লাব থেকে ফেরার পথে রকেট গলি থেকে সাইকেল হাতে বেরিয়ে আসা সীমার প্রেম প্রস্তাব শুনে অনিমেষ টানা দশ মিনিট বাকরূদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সীমা কিন্তু বলে চলেছিল, "শোনো, একটা ডাইরি করবে আর তাতে রোজ আমাদের কথা লিখবে। শুধু আমাদের কথা, আর কিচ্ছু না। আজ থেকে আমি আর তোমায় অনিদা বলব না। কারও সামনেই না। প্রতি শনিবার ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি থেকে পদ্ম পুকুর যাওয়ার রাস্তায় পাঁচ নম্বর ল্যাম্পপোস্টের নীচে ঠিক পাঁচটায় আমরা দেখা করব। আর শোনো, সন্তুদা আর কৌশিকদার সাথে বেশি মেশোনা, ওরা ভালো ছেলে না। ঠিক আছে, এখন আসি। পরশু শনিবার, দাড়িটা একটু ঠিক করে আসবে।" অনিমেষ তখনই জানতো, পদ্মপুকুর হোক বা জাহান্নাম, ওকে যেতেই হবে। এই মানুষটার কথা না মেনে ওর উপায় নেই। সেই প্রথমবার ওর মনে হয়েছিল, ভগবান বলে হয়তো সত্যিই কেও আছেন। নাহলে যে এতো বছর ধরে, ওর মনের সবটা জুড়ে রয়েছে, সে আগ বাড়িয়ে ওকে ধরা দেবে, এটা কি করে হয়? ক্লাবের এমন কোনো ছেলে ছিলনা, যার সীমাকে ভালো লাগতো না। এদের মধ্যে কয়েকজনের ভালো লাগাটা অশ্লীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতো। এই নিয়ে অনিমেষের সাথে সন্তু, শিবু, কৌশিক দের কম ঝগড়া হয়নি। কিন্তু ওরা অনিমেষকে এই বলেই থামিয়ে দিতো, "সীমা তোর কে হয় বে?" আসলে ব্যপারটা সীমাকে নিয়ে ছিলই না কখনো। অনিমেষের প্রশ্ন ছিল, কাওকে পছন্দ করলে তার নিয়ে এহেন অশ্লীল মন্তব্য করা যায় কিভাবে? সীমা এই একবছরে একটাও শনিবার মিস করেনি। বর্ষাকালের গোড়াতে ধুম জ্বর নিয়েও এসে হাজির পাঁচ নম্বর ল্যাম্পপোস্টের নীচে। ওর লাল চোখগুলো দেখে অনিমেষের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠেছিল। খুব ইচ্ছে করছিল, ওকে জড়িয়ে ধরে বুকের ওম দিতে কিন্তু আরও সমস্ত কিছুর মতো সেবারও সীমাই নিজে থেকে ওকে আঁকড়ে ধরেছিল। স্বপ্নের মতো একটা বছর পেরিয়ে গেলো। গতকালও শনিবার ছিল। পদ্মপুকুর থেকে বাড়ি ফেরার পথটুকু অনিমেষ যেন হাওয়ায় উড়ে এলো। ডাইরিতে লিখতে হবে ওদের প্রথম চুম্বনের কথা। আচ্ছা সীমাকে ওই জানোয়ারগুলো কি ওখান থেকেই তুলে নিয়ে গিয়েছিল? সীমা কি অনিকে ডেকেছিল তখন? অনিমেষ কি এতোখানি বুঁদ হয়েছিল যে সীমার গোঙানি ওর মগ্নতা ভাঙাতে পারেনি? আজ সকালে শ্মশানের পাশের রাস্তাটা থেকে সীমার শতছিন্ন নিথর দেহটা ওরা যখন পুঁটলিতে বাঁধছিল, অনিমেষ ওখানেই দাঁড়িয়েছিল। শিবু আর শাহজাহানের মুখের ওপর আঁচড়গুলো ও তখনই লক্ষ করেছিল। সন্তু ঠিক তখনই, কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো, "শিবুদা, শাজাহান আর কৌশিক দা। অনেক মানা করলাম। শুনলো না। সকালে বাড়ি এসে শাসিয়ে গেছে কাওকে বললে, প্রাণে মেরে ফেলবে। তোকে না বলে পারলাম না। পুলিশকে বলতে বলিস না, পারব না।" এই প্রথমবার অনিমেষের পাথরের মতো নিস্পৃহ চোখগুলো দেখে সন্তু ভয় পেলো।
সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। ক্লাবে মদের আসর বসেছে। স্থানীয় পার্টি অফিসের সক্রিয়তা আর পুলিশি নিস্ক্রিয়তায় ব্যপারটা ধামাচাপা দেওয়ার সমস্ত তোড়জোড় প্রায় শেষের মুখে। আজ প্রায় এক বছর পরে অনিমেষ ক্লাবের আসরে যোগ দিয়েছে। সবাই প্রথমে অল্প কিন্তু কিন্তু করলেও পেটে দুপেগ পড়ার পর সবাই ওকে মোটামুটি সাদরেই গ্রহণ করেছে। আফটারঅল পাড়ার সবচাইতে শিক্ষিত ছেলে ক্লাবে থাকলে তো ক্লাবেরই লাভ, তাই না? বোতল হাতে শিবুদার নাচ, শাজাহান আর কৌশিকের গতরাতের অসাধারণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে রসালো এবং জমজমাট বিবরণের পর রাত্রি সাড়ে এগারোটা নাগাদ মোচ্ছবটা প্রায় স্তিমিত হয়ে এলো। এখন অনিমেষকে নিয়ে খালি ওরা চারজন। সারা সময় জুড়ে ওদের তিন জন অনিমেষকে দেখে বেশ কয়েকবার ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে হেসেছে। কৌশিক তো একবার বলেই ফেললো, "এক বছর ধরে কি ছিঁড়লি ভাই? মালটা তো একদম টাটকা ছিল।" শাজাহানের জড়ানো গলায়, "সন্তুটা একটা ভেড়ুয়া" শোনার পর, অনিমেষ উঠলো। ক্লাবের বাইরে এসে আলতো করে শিকলটা তুলে দিলো। পাশের ঝোপটা সরিয়ে কুড়ি লিটারের কেরোসিনের কন্টেনারটা তুলে নিয়ে ক্লাবের দেওয়ালে ছেটাতে শুরু করলো। আজ বিকেলেই সন্তুদের রেশন দোকান থেকে সন্তু ওটা দিয়ে গেছে। এই ক্লাবটা গ্রামের অনেকখানি বাইরে। শ্মশানের ঠিক পাশেই। অনিমেষ ম্যাচিসটা জ্বালালো। দশ মিনিটও লাগলো না ওদের নেশা কাটতে। তিনজনের গগনবিদারী চিৎকারে এখন কান পাতা দায়। অনিমেষ মুচকি হাসলো। এখান থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেলে সীমাটা হয়তো এখন বেঁচে থাকতো। চিৎকারটা আস্তে আস্তে গোঙানিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্লাবটাকে এখন দূর থেকে দেখলে আস্ত একটা চিতা মনে হবে। অনিমেষ থানার পথ ধরলো। শিবু শাজাহানদের চামড়া পুড়ছে। আকাশপথে উঠছে ধোঁয়ার কুন্ডলী। অনিমেষ জীবনে প্রথমবার বাতাসে 'অপরাজিতার গন্ধ' পেলো....প্রথমবার.....