সেদিন পড়তে বসে হঠাৎই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল লিলি। আশ্চর্য হল নবীন। হঠাৎ কি এমন ঘটল যে লিলি কাঁদতে শুরু করল? সে তো ওকে বকেনি। তাহলে? শেষ পর্যন্ত না থাকতে পেরে বলল, কি ব্যাপার লিলি, হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলে ?
কোনো রকমে কান্না থামিয়ে লিলি বলল, আপনি তো কাল থেকে থাকবেন না। তাহলে আমারও পড়াশোনা হবেনা। কেউ আমাকে ভালোও বাসেনা, আমার কথা মনেও রাখেনা।
নবীন -- হঠাৎ এরকম কথা কেন? আমার কথা শোনো --
লিলি -- না, কেন শুনব আপনার কথা। আপনি তো আমার কেউ না।
আরও জোরে কেঁদে উঠল সে।
নবীন ভেবে পেলনা ওর কলকাতায় যাওয়ার সঙ্গে ওর কান্নার কি সম্পর্ক আছে? সে নিজের থেকে ওখানে ভর্তি হতে চায়নি। ওর বাবার প্রস্তাবেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নবীন বলল, শোনো, আমি কলকাতায় যাচ্ছি পড়াশোনা করতেই। আর প্রতি সপ্তাহে শনিবার বাড়ি এসে সোমবার ফিরব। ওই দুদিন তোমাকে পড়া দেখিয়ে দেব।
কান্না থামিয়ে নবীনের ডানহাতটা ধরে লিলি বলল, প্রমিজ ্!
নবীন হঠাৎ ওর এই হাত ধরাতে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।
লিলি -- আপনি না পড়ালে আমি ইচ্ছে করেই ফেল করব।
বেশ কিছুক্ষণ হাতটা ধরেই রইল লিলি। ওর আবেদনটা বুঝতে পারে নবীন। কিন্তু ওর ছোট্ট মনে আঘাত দিতে চাইলনা সে। ওর প্রতি যে লিলির একটু দুর্বলতা আছে সেটাও সে বুঝতে পারে। ওর মনে হয় বয়স বাড়লে হয়তো এজাতীয় দুর্বলতা একটু কমলেও কমতে পারে। হাতটা সরিয়ে নিলে যদি ও কষ্ট পায় সেজন্য সে চুপ করে বসে রইল।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর লিলি বলল, ওখানে গেলেও, প্রতিদিন সন্ধ্যের সময় ফোনেই আমাকে পড়া বুঝিয়ে দেবেন?
নবীন -- বেশ তাই হবে।
লিলি -- আমাকে ছুঁয়ে বলেছেন। ভুলে গেলে কি হবে দেখবেন?
নবীন -- কি হবে?
লিলি -- জানিনা।
হাতটা সরিয়ে নিয়ে নবীন বলল, বেশ এখন পড়াটা শুরু করো।
লিলি -- আজ পড়তে ভাল্লাগছে না। মনে হচ্ছে সবসময় আপনার সঙ্গে গল্প করি। আপনার ইচ্ছে করছেনা?
নবীন -- না। দেখো আমি তোমাকে পড়াতে এসেছি। এখন না পড়িয়ে গল্প করে সময়টা কাটিয়ে দিই, তাহলে সেটা কি অন্যায় হবেনা?
লিলি -- কেন হবে? আমি চাইছি বলেই তো। আপনি কেমন সুন্দর করে গল্প বলে পড়াটা বুঝিয়ে দেন -- অন্যরা তেমনটা পারেনা।
নবীন -- এখন ওসব থাক। ম্যাথটা দেখাও।
লিলি -- আপনি না খুব দুষ্টু। এই নিন --
অঙ্কের খাতাটা এগিয়ে দিল লিলি। নবীন দেখল প্রায় সব অঙ্কই ঠিক করেছে সে। ভেবেছিল অঙ্ক ভুল করলেই ওকে খুব বকুনি দেবে। কিন্তু সেটা আর হলনা।
লিলি উঠে বলল, চা নিয়ে আসি?
নবীন -- কেন, তোমার মাসিমনি বাড়ি নেই?
লিলি -- না। বাপির সঙ্গে কোথায় যেন গিয়েছে।
গম্ভীর কণ্ঠে নবীন বলল, চা লাগবেনা, বসো।
লিলি -- বসছি বাবা বসছি। এখনি ভালো ছিলেন -- এখনি আবার অমিতাভ বচ্চন হয়ে গেলেন?
হেসে ফেলল নবীন। সত্যিই এই পাগলীটাকে কিভাবে সে পড়াবে ভেবে পায়না।
কোনো ভাবে পড়ানোটা শেষ করে ওখানেই খেয়ে আসতে হল তাকে।
পরদিন বেশ ভোরেই উঠল নবীন। এক সপ্তাহ পরে ফিরতে পারবে। সেজন্য সব কিছু গুছিয়ে রাখল। ধবলীকে কিছুদিনের জন্য বিষ্টু কাকার বাড়িতে রেখে এসেছে। এখন কলকাতায় থাকতে হলে ধবলীর কিভাবে দেখাশোনা হবে কে জানে?
একজন প্রতিবেশী ওকে বিক্রির কথা বললেও ওর মন সায় দেয়নি। মনে হয়েছে ধবলী তার মায়ের মতো। তাকে হস্তান্তর করা যায়না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে কি হবে কে জানে?
সকালে বেরোবার আগেই লিলি এসে হাজির। নবীন আশ্চর্য হয়ে বলল, কি ব্যাপার?
লিলি -- আপনার পেনটা আমাদের বাড়িতে ছিল।
নবীন -- হ্যাঁ তাইতো। কিন্তু এটা দেওয়ার জন্য তোমার এতো সকালে আসার দরকার ছিলনা।
লিলি -- না, মানে আসলে --
নবীন -- কি ?
লিলি -- কিছুনা।
নবীন -- বুঝেছি।
লিলি -- কিচ্ছু বোঝেননি আপনি। বোকার মতো বললেন, বুঝেছি।
নবীন -- ঠিক আছে। শোনো তুমি কিন্তু পড়াশোনায় একদম ফাঁকি দেবেনা। মনে থাকবে?
লিলি -- না থাকবেনা। কি হবে পড়াশোনা করে। আমি তো আর চাকরিবাকরি করবনা।
নবীন -- তাহলে কি করবে তুমি?
লিলি -- সে যাহোক করব। আপনাকে বলব কেন?
নবীন -- বেশ বলতে হবেনা!
লিলি ওর অনেক কাছে সরে এসে বলল, রাগ করলেন?
নবীন - - না তো।
লিলি ওর জামার বোতামটা লাগিয়ে দিয়ে বলল, নিজের খেয়াল রাখবেন। আর ফোন করবেন।
শেষের দিকে ওর গলাটা বুঝি কেঁপে উঠল। চোখদুটোও বুঝি জলে ভরে উঠল।
নবীন আলতো করে ওর মুখটা ধরে বলল, কি হয়েছে? কাঁদছ কেন? আমি তো তোমার তেমন কেউ না। শুধু মাত্র গৃহশিক্ষক। বেতনভুক। সামান্য একজন গৃহ শিক্ষকের জন্য চোখে জল শোভা পায়না।
লিলি ওর মুখে হাত দিয়ে বলল, এসব বলবেন না।
নবীন -- দেখো, তুমি বয়সে বেশ ছোটো। কিন্তু এতটা ছোটো নও যে নারী পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারটা একেবারেই বোঝোনা। তোমার এখন পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকা দরকার। ভালো যে কাউকেই লাগতে পারে। কিন্তু সেখানে বিচারবোধ থাকা প্রয়োজন। তুমি যে এখানে এসেছো -- নিশ্চয় কাকু এটা জানেন না। তাছাড়া তুমি তো জানো এখানে বিবাহপূর্ব মেলামেশাকে ভালোচোখে দেখা হয়না। এতে তোমাকে কেউ খারাপ বলতেই পারে।
লিলি -- বলুকগে। আপনি আমার স্যার -- আপনার কাছে আমি যে কোনো সময় আসতেই পারি। তাতে কারোর কিছু বলার থাকতে পারেনা।
আশ্চর্য হল নবীন। মানসিক ভাবে ওকে বেশ দৃঢ় বলে মনে হল ওর। টিন এজে পৌঁছে বেশ বেপরোয়া লিলি। সেও টিন এজ্ পার হয়ে সবে মাত্র যৌবনে পা দিয়েছে । কিছুটা হলেও ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছে। সে কিভাবে ওর ভালো লাগাকে প্রশ্রয় দিতে পারে? আবার বেশি বোঝাতে গেলে সে যদি হঠকারী হয়ে ওঠে? যদি কিছু একটা করে বসে? তার চেয়ে ধীরে ধীরে ওকে বুঝিয়ে বলবে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নবীন বলল, চোখদুটো মুছে নাও। পড়াশোনা করে বড় হও তারপর এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিও।
পা বাড়াল নবীন।
লিলি ওকে প্রনাম করে বলল, সাবধানে যাবেন।
সত্যি, এই পাগলী মেয়েটা তাকেও পাগল করে ছাড়বে। সে নিজে জানে, কিছুটা হলেও লিলির প্রতি তার দুর্বলতা আছে। তবু সে যদি এখন লিলিকে প্রশ্রয় দেয় তাহলে কি সেটা অন্যায় হবেনা? কিন্তু এই মুহূর্তে লিলিকে আঘাত দেওয়া উচিত হবেনা। তার থেকে ব্যাপারটা ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাক। সে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল আসি। লিলি ওকে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে বলল, আসুন।
নবীন -- কিন্তু তুমি একি করলে?
লিলি -- আমার অতো ধৈর্য্য নেই। আপনার তো সাহস নেই। তাই আমিই দিলাম।
নবীন -- ভবিষ্যতে যদি কোনো কারণে আমাকে না পাও, তাহলে যে তোমার খুব কষ্ট হবে।
লিলি -- ভবিষ্যৎ নিয়ে এতো ভাবিনা।
অরুণার কথা মনে পড়ল। সেও এতো কিছু ভাবতনা। তার সম্মতির অপেক্ষা না করে কোন্ বালিকা বেলায় ওর কাছে এসেছিল। তারপর বয়স বাড়তেই বদলে গেল সে। লিলিও অরুণার মতো বদলে যাবেনা তো? বেশ কিছুক্ষণ লিলির মুখের দিকে চেয়ে রইল সে। না, ওই মুখে অরুণার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেনা বটে। হয়তো সত্যিই লিলি তাকে -- কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে দেখল লিলি হাত নাড়ছে। সেও হাত নাড়তে নাড়তে বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় গিয়ে উঠল।
কলকাতায় এসে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল ভর্তি হতে এবং থাকার ব্যবস্থা করতে। একটা মেস বোর্ডিংয়ে থাকতে শুরু করল। নিয়মিত ফোন করল লিলিকে।
মিলি ওর দিদি কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে পড়াশোনা করত থাকত ওর মামার বাড়িতে। একদিন বিকেলের দিকে
এল দেখা করতে। ওর অনুরোধেই লিলিকে পড়াতে শুরু করেছিল সে। গ্রামের বাড়িতে ওকে অনেক আন্তরিক মনে হত। কিন্তু এখানে মনে হল সে যেন অনেকটা যাণ্ত্রিক। সেই প্রাণখোলা হাসি দেখতে পেলনা ওর ঠোঁটে। তবে খুব সেজেছে সে। কিছুটা হেঁটে গিয়ে বড় রাস্তার পাশে একটা কফিশপে গিয়ে বসল ওরা।
বাড়িতে কে কেমন আছে -- এসব নিয়ে মামুলি দুচারটে কথা হল। কফিটা খেয়েই চেয়ার থেকে উঠে বলল, আমার খুব তাড়া আছে। উঠি এখন।
চলে গেল সে। নবীনের মনে হলো, মিলিও কি কোলকাতায় এসে বদলে গেল? না কোনো কারণে ও চাপের মধ্যে আছে? তাছাড়া মিলিতো বেশ খোলাখুলি কথা বলতে পারে। যদি ও কোনো কারণে সমস্যায় থাকে তাহলে তো সে বলতে পারত?
কয়েকদিন পরে বাড়ি ফিরল। চাবিটা লিলির কাছেই ছিল। যাবার সময় নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লিলি এবং ওদের কাজের লোক হারু এসে দরজা খুলে দিল। নবীন দেখল বাড়িটা বেশ ঝকঝকে তকতকে করে রেখেছে ওরা। এমনটা ছিলনা। সত্যিই কাজের মেয়ে লিলি। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘর গেরস্থালির ব্যাপারটাও বেশ বোঝে।
লিলি আজ বেশ খুশি। পড়াতে বসেও ওকে বেশ আন্তরিক বলে মনে হল। হোম ওয়ার্কগুলোও ঠিক ঠিক করে রেখেছে। এখন আর দুষ্টু মেয়ে বলা যাবেনা।
পরদিন সীতার বাড়ি থেকে ঘুরে এসে বিকেলে নদীর ধার বুড়ো পাকুরতলায় বসেছিল নবীন। শরতের শুরু। ধানক্ষেতের ওপর মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে চলেছে। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। বেশ একটা রোমান্টিক পরিবেশ। ঠিক এই রকম পরিবেশেই সে অরুণার কাছ থেকে পেয়েছিল প্রথম উপহার।
এখানে আসলেই ভুলতে চাইলেও বারবার অরুণার কথা মনে পড়ে। উঠে চলে আসবে ঠিক এরকম সময়ে দেখল আলপথ ধরে এগিয়ে আসছে লিলি এবং ওর এক বন্ধু। কি ব্যাপার কে জানে? ওরা কাছে আসতেই নবীন বলল, কি ব্যাপার নদীর ধারে আসলে যে?
লিলি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আনেননি। তাই এই বন্ধুটাকে সঙ্গে নিয়ে এলাম। এই নদীর ধারটা খুব সুন্দর! তাই না স্যার?
নবীন -- তা বটে। তবে --
লিলি -- তবে আবার কি? আসুন তো --
ওর হাত ধরে টানতে টানতে জলের কাছাকছি নিয়ে যায়। স্নিগ্ধ স্রোতস্বিনীর পরিষ্কার জলে প্রতিবিম্বিত হয় ওরা।
লিলি -- খুব সুন্দর, তাই না?
নবীন -- হ্যাঁ।
লিলি -- আপনি কিছু ভাবছেন?
নবীন -- না তো।
লিলি -- তবে কথা বলছেন না যে?
নবীন -- বলছিতো।
লিলি ওর বন্ধুকে ডেকে বলল, এই মিতা শোন্, ইনি আমার স্যার।
মিতা -- জানিতো। তোর স্যার খুব ভালো। তোকে বকেনা, বরং ভালোবাসে। আর আমার স্যার আমাকে শুধুই মারে।
নবীন -- তুমি নিশ্চয় পড়াশোনা করোনা।
মিতা -- করিতো, তবু মারে। আপনি লিলির সঙ্গে আমাকে পড়াবেন?
লিলি -- মোটেই না। আমার স্যার শুধু আমাকেই পড়াবেন। বুঝেচিস?
মিতা -- ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। আমি যেন তোর স্যারকে কেড়ে নিচ্ছি?
নবীন -- ঠিক আছে চলো এখন।
ওরা ফিরতে শুরু করল। নবীন বুঝতে পারল লিলির কিশোরী মন তার স্যারের ভাগ সে কাউকে দেবেনা। সে দিদিই হোক অথবা বন্ধু। এখানে সে বড্ড স্বার্থপর। আর এটাই হয়তো মেয়েদের একটা চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। লিলি কি তাকে গভীর ভাবে ভালোবাসে না এটা তার কৈশোরের খেয়াল? ( সমাপ্ত )

রথীন্দ্রনাথ রায়: সাংবাদিক লেখক