"এর মধ্যেই কাজ হয়ে গেলো তোমার?"... এক রাশ বিরক্তিতে ভ্রূ কুচকে ওঠে রত্নার, একটু বোধহয় জোরেই বলে ফেলে কথাটা। ওমনি তিনগুন তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে বন্দনা,"হ্যাঁ... হইয়ে গেলো! একুন এর বেশি আর হবে নেকো! একশো দিনের কাজ, আটটার মধ্যে জইন দিতে হবে, না হলি আর নেবেনেকো। আপনেদের কাজ নে পড়ি থাকলি চলবে? যুব কাট নষ্ট হয়ই যাবে। ইবার ট্যাকা পেলি পায়খানা তোয়ের করাবো, রাত বিরেতে মাঠে ঘাটে জাতি হয়, আপনেরা কি বুজবেন বলেন! "বলতে বলতে শন শন করে ঝাঁটা চালিয়ে উঠোন ঝাঁট দিয়ে ঝাঁটা টা আছড়ে ফেলে, ঘটাং ঘটাং করে গেট খুলে খট খট করে বেরিয়ে গেলো! নিশ্বাস টুকু ফেলার সময় পেলনা রত্না। ইতিমধ্যেই পাশের বাড়ির জানলা ঈষৎ ফাঁক করে নন্দার মজা দেখার আশায় উঁকি দেওয়া, দৃষ্টি এড়ায়নি রত্নার। উঃ! একটা যেন ঝড় বয়ে গেলো! এত মুখরা মানুষ হয়! বাপরে বাপ! দরকার নেই, ও বেলা কাজে এলে জবাব দিয়ে দেবে রত্না।
এইতো কয়েকদিন আগে একবার বলে ফেলেছিল রত্না, ওর কাজকর্ম বড়ো অগোছালো, ওর বর অনাথের কাজ খুব পরিষ্কার। উত্তরে একেবারে হাত পা নেড়ে বন্দনার কি লেকচার......বেশ তো, রেখে দিন ওকে আপনার চাকর করি, বুড়ো হোলি পেং শেং দিবেন, চিকিচ্ছে করাবেন। "রাগতে গিয়েও রাগতে পারেনা রত্না, হেসেই বলে,"সত্যি তোমার কথার কি বাঁধন বন্দনা! পার্টির লোকজন তোমার সন্ধান পেলে একেবারে লুফে নেবে।" পরশু দিন বললো, সামনের সপ্তাহে মেয়ের বাড়ী যাবে, কাজে আসবে না। রত্না তো আঁতকে উঠল "না না, সামনের সপ্তাহে একেবারেই ছুটি নেওয়া যাবে না, স্কুলের পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে! "অম্লান বদনে বললো,"ছি এল নিবেন, আমাদের তো ছিএল নেই, দক্কারে অদককারে ছুটি নিতি হবে বৈকি। "একেবারে সাফ জবাব। তাও যেদিন ফিরবে বলে সেদিন কি ফেরে? কোনো দিনও না। বললে বলে, "আমরা গরীব নোক,আমাদের অত কতার দাম রাখতে হবে তার কি মানে আছে? সুবিদে অসুবিধে থাকবে নিকো? বললেই অমনি ফেরা যায়? "অথচ যখন যেটা দরকার একেবারে জোর জুলুম করে আদায় করে ছাড়বে।....ও দিদি, ওই কমলা রঙের তাঁতের শাড়ীটা তো বহুত দিন পল্লেন, ই বার ছাড়ান দিন,"..... বলেই আর মতামতের অপেক্ষা না রেখে ছাড়া শাড়ীটা সার্ফ এ ভিজিয়ে কেচে ভাতের মাড় দিয়ে রত্নার উঠনেই শুকিয়ে বিকেলে পাট করে নিয়ে চলে গেল। রত্না কিছু বলতেই পারলনা। সেদিন ছেলের পুরনো জামাকাপড় গুলো রোদ্দুরে দিয়েছিলো, সবই ছোটো হয়ে গেছে,এখন আর পরেও না, তবু নানা ঘটনা, নানা স্মৃতি এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই, দিয়ে দিলেই হয় ভেবেও দিতে হাত ওঠেনা। হটাৎ এসেই একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দনা...."ওরে বাপরে! এই এত গুলো জামা প্যান রেকে দিয়েছেন পুতুপূতু করি? নাতির জন্যি নাকি? দিন দিকিনি, আমার ছেলেটার জন্যি গোটাকতক, ওসব বাকসো পচা করে কি হবে? "বলেই ঝপাঝপ করে কতকগুলো বেছে নিলে। রাগ করতেও পারে না রত্না, বরং একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে, সত্যিই তো! সেন্টিমেন্টের দাম বেশী না ওর প্রয়োজনের। কতকগুলো স্মৃতি ধরে রাখতে গিয়ে , বা হাতে তুলে দেওয়ার প্রবণতা কম বলে ওই জামাপ্যান্ট গুলো আঁকড়ে রেখেছে ও।ওগুলো নিজে হাতে নিয়ে ভালোই করলো বন্দনা। আবার দুটো পুরনো সোয়েটার চাদর খুঁজে রাখার অর্ডার করে গটগট করে চলে গেলো। ওর এই জোর জুলুম এর কাছে কেমন যেন অসহায় হয়ে যায়। কারণটাও অজানা নয় রত্নার। সামনা সামনি যতই জোর জুলুম করুক না কেন ,না বলে কিন্তু একটা ছুঁচও নেবেনা, এ ব্যাপারে স্বামী স্ত্রী দুজনেই খুব সৎ। বছর খানেক আগে খাটের ওপর একটা পাঁচ হাজার টাকার বান্ডিল ফেলে রেখে বাজার চলে গিয়েছিল রত্নার বর উজ্জ্বল। ঘর ঝাড়তে এসে দেখে সে টাকা রত্নাকে ডেকে তুলে রাখতে বলেছিলো অনাথ। খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ, একেবারে বন্দনার বিপরীত। তাই বন্দনর এই উদ্ভট আচরণ সহ্য করে নেয় রত্না। কিন্তু আজকে যেন বড়ো অসহ্য লাগছে। স্কুলে বেরোনোর মুখে মনটা বড়ো খিচড়ে গেছে। আপাতত মাথাটা ঠান্ডা রেখে দ্রুত কাজ সামলায় রত্না। ঘরে তালা চাবি দিয়ে রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করে। এখানেও সেই একশো দিনের কাজ। বাঁধা রিকশাওয়ালা রিকশায় চেন বেঁধে দিয়ে একশো দিনের কাজে চলে গেছে। অগত্যা হন্টন। স্টেশনে পৌঁছে হাঁফায় রত্না। প্লাটফর্মে বেঞ্চে বসে জলের বোতলটা খুলে জল খায় ঢক ঢক করে। ট্রেন এসে দাঁড়াতেই উঠে পড়ে লেডিস কামরায়।
আগের মত লেডিসে আর ততটা কলরব শোনা যায় না। নতুন প্রজন্মের মেয়েরা যে যার সিটে বসে মোবাইল ফোনে মগ্ন। পরনে জিন্স, টপ, কানে কর্ড, সব যেন জ্যান্ত রোবট। ওরই মধ্যে রত্নার মত মাঝ বয়সীরা নিজেদের মধ্যে গল্প করে মৃদুস্বরে, নতুন প্রজন্মের নীরবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। অনেক শিক্ষিকাও আছে এই কামরায়। কয়েক জনের সাজ সজ্জায় বড়ো রুচির অভাব। জানলার দিকে বসা মেয়েটির দিকে বার বার চোখ চলে যায় রত্নার, কি উগ্র সাজ। চেহারায় মেদ যতখানি বাড়তি, ব্লাউজের ঝুলে ততটাই ঘাটতি। পুরু ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। পাশে বসা মিনতি ফিসফিস করে বলে, "দেখছেন কি, উনিও একজন শিক্ষিকা। এর থেকে বাবা চুড়িদার পড়া অনেক ভালো, অবশ্য ভদ্রভাবে পড়লে। কি যে রুচি হয়েছে সব! এর জন্য দায়ী ওই টিভি আর সিনেমা। ছোটো ছোটো পোষাক না পড়লে বুঝি অভিনেত্রী হওয়া যায় না? আমাদের সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন এরা কি অভিনয় করেন নি? জগৎ জোড়া নাম। আর এখন দেখো! যতো বড়ো অভিনেত্রী ততো ছোটো পোশাক। আর এই সব নকল করে আমাদের ঘরের ছেলেমেয়ে গুলো উচ্ছন্নে যাচ্ছে। কিন্তু তুমিতো একজন শিক্ষিকা, তোমার একটু মার্জিত পোশাক পরা উচিৎ নয় কি?" গজ গজ করতে থাকে মিনতি। ইতিমধ্যেই রত্নার স্টেশন এসে যায়। আসছি গো...বলে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে রত্না। স্কুলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বন্দনার ওই বিশ্রী ব্যবহারের কথা কাঁটার মত খচ খচ করতে থাকে।
বাড়ী ফিরেও মনের কষ্টটা যায় না। ঠিক করেই ফেলে রত্না, আজ ওকে কাজ ছেড়ে দেবার কথা বলবেই
বলবে, তাতে যা হয় হবে। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে রত্না। নিজের মনে বলে, "রাজা বিনে রাজ্য আটক যায়না তো......।" হটাৎ ঝনাত করে গেট খোলার
আওয়াজে চমকে ওঠে,জা নলা দিয়ে দেখতে পায় নিজের
মনে বিড়বিড় করতে করতে কাজে এলো বন্দনা, হাতে এক গোছা কুলেখাঁড়া
শাক। টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় শুরু করে দিলে, "অ্যাই দেকেন টাটকা শাগ গুলান নিয়ে এইছি, ঝোল করি খাবেন, অক্ত হয়, অপরসন করি করি বল বলতি তো নেইকো শরীলে। মনিদের গাচে কচি কচি ডুমুর হইছে, ক' দিন পর এনে
দোবো।" তারপরই সোফায় জড়ো করে রাখা জামা কাপড় ভাঁজ করতে করতে বলে, "দাদার একটা নোম্বা হাতা পুরনো জামা খুঁজে রেকবেন তো আমার জন্যি, কাপড়ের উপুর পরি
নোবো। মাটির ঝুড়ি মাতায় তুলার সময় বড্ডো গা গতর বেইরে পড়ে,বেআব্রু হইয়ে যাই, বড্ডো নজ্জা
করে"। নির্বাক তাকিয়ে থাকে রত্না
ওর দিকে! কিছুক্ষণ আগের প্রতিজ্ঞার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে নিজের অজান্তেই বলে ওঠে, "তোমার জামা কাপড় গোছানো হয়ে গেলে একটু লিকার চা করতো বন্দনা, মাথাটা বড্ডো
ধরেছে।"